Saturday, March 9, 2013

নারায়ণগঞ্জে মেধাবী কিশোর খুন

‘ওর কোনো শত্রু ছিল না। শত্রু সব আমার। আমার কাজে যারা ক্ষুব্ধ, তারাই আমার ছেলেকে খুন করেছে।’ সন্তানের মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে এসব কথা বলতে বলতে অঝোরে কাঁদছিলেন নারায়ণগঞ্জের গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি। যে প্রতিবাদী মানুষটিকে কেউ কখনো কাঁদতে দেখেনি, আজ তাঁর চোখে পানি দেখে চোখ ভিজে আসে সবার।
রফিউর রাব্বির বড় ছেলে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকিকে খুন করা হয়েছে। দুই দিন নিখোঁজ থাকার পর গতকাল শুক্রবার সকালে ১৭ বছরের এই কিশোরের মৃতদেহ পাওয়া যায় নারায়ণগঞ্জের চারারগোপে শীতলক্ষ্যার নদীর নৌযান নোঙর করার খালের (হারবার) কাঁদা পানিতে। তানভীর এ বছর ‘এ’ লেভেল পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছে। ফল বেরিয়েছে নিখোঁজ হওয়ার এক দিন পর গতকাল। ফল আর জেনে যেতে পারেনি সে।
নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ছেলেটিকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। তার মুখে, ডান চোখে ও গলায় আঘাতের চিহ্ন আছে। তবে খুনের কারণ এবং খুনিদের শনাক্ত করা যায় এমন কোনো সূত্র এখনো মেলেনি।
নিরপরাধ কিশোরের এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে নারায়ণগঞ্জের মানুষ। গতকাল দুপুরে জুমার নামাজের পর সর্বস্তরের মানুষ কালো পতাকা নিয়ে শহরে বিক্ষোভ মিছিল করেছে। সন্ধ্যার পর মশাল মিছিল করেছে জেলা সাংস্কৃতিক জোট। আজ সেখানে সকাল-সন্ধ্যা হরতালও ডেকেছে জোট। হরতালে সমর্থন দিয়েছে সিপিবি, বাসদ, ন্যাপ, ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দল ও গণসংহতি আন্দোলন।
রফিউর রাব্বি দুই ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন শায়েস্তা খান সড়কের পুরাতন কোর্ট রোডের বাসায়। দুই ভাইয়ের মধ্যে তানভীর বড়। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবিসি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল থেকে সে এবার ‘এ’ লেভেলে পাস করল। তার বন্ধুরা জানাল, সে খুব চুপচাপ স্বভাবের, পড়াশোনার বাইরে আর কিছুই করত না। বন্ধুও তেমন ছিল না। মা ছিল তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু।
এবিসি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, নিখোঁজ হওয়ার পরদিন বৃহস্পতিবার তার পরীক্ষার ফল বের হয়। পদার্থবিজ্ঞানে ৩০০ নম্বরের মধ্যে ২৯৭ পেয়েছে সে। এটা দেশের সর্বোচ্চ নম্বর। ‘ও’ লেভেল পরীক্ষায়ও সে পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিল।
বাবা রফিউর রাব্বি প্রথম আলোকে বলেন, গত বুধবার বিকেলে বাসা থেকে বের হওয়ার পর আর ফেরেনি তাঁর ছেলে। তিনি বিষয়টি লিখিতভাবে র‌্যাব ও পুলিশকে জানান। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আশরাফউদ্দৌলা বলেন, গতকাল বেলা পৌনে ১১টার দিকে শহরের চারারগোপ শীতলক্ষ্যা নদীতে মৃতদেহ ভাসতে দেখে স্থানীয় লোকজন পুলিশকে খবর দেয়। পরে ওর বাবা মৃতদেহ শনাক্ত করেন। তার ব্যবহূত মুঠোফোনটি প্যান্টের পকেটেই ছিল।
মৃতদেহ নারায়ণগঞ্জ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। ময়নাতদন্ত শেষে দুপুরের পর মৃতদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ সময় মর্গে ছুটে আসেন নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ব্যবসায়ী মহলের লোকজন।
হাসপাতালে তানভীরের চাচা কবি ওয়াহিদ রেজা বলেন, ওর কোনো শত্রু ছিল না। এ রকম একটি ছেলেকে কারা খুন করল?
খুনের কারণ নিয়ে ভাবনা: নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি প্রদীপ ঘোষ বলেন, গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন নাগরিক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। নারায়ণগঞ্জে বাসভাড়া বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সব সময় তিনি সোচ্চার।
মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, ‘বাসভাড়া কমানোর দাবিতে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ায় একটি মহল রাব্বির প্রতি ক্ষুব্ধ। রাব্বি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় আমার পাশে থেকে আমাকে সাহস জুগিয়েছেন। তা ছাড়া সব ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন। এ কারণে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ। এই মহলটিই এ হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে।’ মেয়র বলেন, এর আগে আশিক ও চঞ্চল নামের দুই যুবককেও একই কায়দায় খুন করা হয়। তিনজনের লাশই শীতলক্ষ্যা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
খুনের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয় লোকজন বলেন, রফিউর রাব্বির সামাজিক কর্মকাণ্ড নিয়ে জামায়াত-শিবির যেমন ক্ষুব্ধ, তেমনি ক্ষুব্ধ নারায়ণগঞ্জের একটি প্রভাবশালী মহলও। এ খুনের পেছনে এ দুই গোষ্ঠীর যেকোনো একটির হাত থাকতে পারে।
হরতালে সমর্থন: নারায়ণগঞ্জ-৫ (শহর-বন্দর) আসনের জাপাদলীয় সাংসদ নাসিম ওসমান গতকাল এক বিবৃতিতে তানভীর হত্যাকারীদের বিচারের দাবি করেন। তাঁর মেজো ভাই নারায়ণগঞ্জ চেম্বার ও বিকেএমইএর সভাপতি সেলিম ওসমান বিকেলে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে লাশ দেখতে গিয়ে আজকের হরতালের প্রতি সমর্থন জানিয়ে দোকানপাট বন্ধ রাখার আহ্বান জানান। চেম্বারের ব্যানারে আজ চাষাঢ়া এলাকায় প্রতিবাদ সমাবেশ ডেকেছেন সেলিম ওসমান।
পুলিশ যা বলছে: জেলা পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তানভীরের বাবা রাব্বির প্রতি ক্ষুব্ধ কোনো গোষ্ঠী এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে কি না, পুলিশ তা খতিয়ে দেখছে। তিনি জানান, নিহত কিশোর নিখোঁজ হওয়ার আগ পর্যন্ত তার মোবাইল ব্যবহার করে চলতি মাসে মাত্র তিনটি কল করেছে। দুবার কথা বলেছে মায়ের সঙ্গে। তবে তার ফেসবুক, ই-মেইল ও মোবাইলের খুদে বার্তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে, নিখোঁজ হওয়ার আগে বাসা থেকে কেউ তাকে ডেকে নিয়েছিল কি না।
মিছিল: ময়নাতদন্ত শেষে দুপুরে লাশ ও কালো পতাকা নিয়ে মিছিল করে সাংস্কৃতিক জোট। মিছিলে অংশ নেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফসহ অন্য নেতারা। মিছিলে স্লোগান ছিল, ‘আমার ভাই মরল কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘খুন হয়েছে আমার ভাই, খুনি তোদের রক্ষা নাই’। মরদেহ বাসায় নেওয়া হলে সমাজের বিভিন্ন স্তরের শত শত মানুষ ভিড় জমায়। বিকেলে শহরের চাষাঢ়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। বাদ মাগরিব শহরের আমলাপাড়া জামে মসজিদে জানাজা শেষে বন্দরে সিরাজ শাহ্র আস্তানায় পারিবারিক কবরস্থানে তার মৃতদেহ দাফন করা হয়।