কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের দুই পাশে বিশাল যে রেইনট্রিগুলো এত দিন প্রকৃতির
কোলে পর্যটকদের স্বাগত জানিয়ে আসছিল, সেগুলোর একটা বড় অংশ এখন আর নেই। ২০
থেকে ৪০ বছর বয়সী ওই গাছগুলোর ছায়ায় প্রাণ জুড়াত পথচারীরা। পাখপাখালির
আশ্রয়ও ছিল তারা। সে গাছগুলো কেটে ফেলেছে জামায়াত-শিবির।
এই অবস্থায় আজ বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক বন দিবস। এ দিবসের
এবারের প্রতিপাদ্য— জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে বন। বাংলাদেশে গাছের ওপর আঘাত
করে ঠিক যেন জীবন-জীবিকার ওপরই আঘাত করা হলো। প্রকৃতিবিদেরা একে রাজনীতির
নামে প্রকৃতির প্রতি প্রতিহিংসার এক নিকৃষ্ট নজির হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
বন বিভাগের সূত্র ও প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, সড়ক অবরোধের নামে গত
২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে একই কায়দায় দেশের ১০টি জেলার প্রধান সড়কের পাশের প্রায়
২০ হাজার ছায়াবৃক্ষ ধ্বংস করেছে জামায়াত-শিবির। এই ২০ হাজার গাছের সঙ্গে
আরও কাটা গেছে লাখ খানেক গাছের লতাগুল্ম ও বড় গাছের ডালপালা। আর্থিক হিসাবে
এতে প্রায় ২০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সর্বশেষ এই প্রকৃতি ধ্বংসে
যুক্ত হয়েছেন বিএনপির কর্মীরা। গত মঙ্গলবার কুমিল্লা-চাঁদপুর মহাসড়কের ওপর
তাঁরাও গাছ কেটে অবরোধ তৈরি করেন। নোয়াখালী ও সাতক্ষীরায় মঙ্গলবার
জামায়াত-শিবির আবারও গাছ কেটেছে।
বন বিভাগের কর্মী ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাপক হারে
এই গাছ কাটতে বিশেষ ধরনের যান্ত্রিক করাত ব্যবহার করা হয়েছে। কক্সবাজার ও
সাতক্ষীরার কয়েকটি করাতকলের মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাতে বহনযোগ্য
ও দ্রুত গাছ কাটা যায় এমন করাত সাম্প্রতিক সময়ে চীন থেকে মিয়ানমার সীমান্ত
দিয়ে বাংলাদেশে আসছে। বিশেষ করে টেকনাফ, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সুন্দরবন
এলাকায় এই করাত গাছচোরেরা সম্প্রতি ব্যবহার করছে বলে একাধিক সূত্র জানায়।
কক্সবাজারের সূত্রগুলো বলছে, রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে চীনের তৈরি এই করাতগুলো
বাংলাদেশে ঢুকেছে। বন বিভাগের কোনো কোনো কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী
বাহিনীর সূত্রগুলো মনে করছে, সড়ক অবরোধের জন্য এই ব্যাপক বৃক্ষ নিধনের
পরিকল্পনা নিয়ে জামায়াত-শিবির আগেই এমন বিপুলসংখ্যক করাত সংগ্রহ করেছে।
হাতে বহনযোগ্য তিন থেকে নয় ফুট পর্যন্ত লম্বা যান্ত্রিক এই করাত দিয়ে একজন
মানুষ ৫ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে একটি গাছ কেটে ফেলতে পারে। এই ধরনের করাতের
সামনের দিকে একটি ধারালো ব্লেড থাকে, যা রাবারের বেল্টের মাধ্যমে সচল হয়।
সাধারণ বনের গাছ দ্রুত কাটতে গাছচোরেরা এটি ব্যবহার করে থাকে।
মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর
ফাঁসির রায় ঘোষণার পর কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, চাঁদপুর, সাতক্ষীরা,
ঝিনাইদহ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা ও রাজশাহী জেলার প্রধান সড়কের
গাছ নির্বিচারে কেটে অবরোধ করেন জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। আর অবরুদ্ধ
এলাকায় চালানো হয় হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট।
সবচেয়ে বেশি গাছ কাটা হয়েছে নোয়াখালী জেলায়। সেখানে প্রায় আট হাজার গাছ
নিধন করা হয়। এই গাছগুলোর মধ্যে প্রায় পাঁচ হাজারই ছোট গাছ। বাকিগুলো ১০
থেকে ১৫ বছর বয়সী। সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের হিসাব অনুযায়ী, সাতক্ষীরা জেলা
শহরে প্রবেশের প্রধান সড়কগুলোর দুই পাশের প্রায় তিন হাজার গাছ কাটা হয়।
সাতক্ষীরার আশাশুনি সড়ক, কলারোয়া সড়ক ও সাতক্ষীরা-খুলনা প্রধান সড়কের দুই
পাশে আকাশমণি, বেলজিয়াম, মেনজিয়াম, রেইনট্রি ও কড়ইগাছের শোভাও এতে ধ্বংস
হয়েছে। এগুলোর বেশির ভাগের বয়সও ১০ থেকে ১৫ বছর।
চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, বাঁশখালী ও লোহাগাড়ায় প্রায় দুই হাজার গাছ কাটা
হয়েছে। এগুলো প্রায় সবই পুরোনো গাছ। কক্সবাজারে প্রায় ২০০ এবং বাকি সাতটি
জেলায় প্রায় তিন হাজার গাছ ধ্বংস করা হয়। কক্সবাজারের গাছগুলো দেশের অন্যতম
পুরোনো। স্থানীয় করাতকল মালিকদের তথ্য অনুযায়ী, এ রকম একেকটি গাছের দাম
প্রায় এক লাখ টাকা। আর ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সী গাছের দাম স্থান ও প্রকৃতিভেদে
২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা বলে সূত্রগুলো দাবি করেছে।
নিধনের শিকার গাছের বেশির ভাগই সামাজিক বনায়নের আওতায় গ্রামের গরিব মানুষ
সরকারের সহায়তায় রোপণ করেছিল। গ্রামের গরিব মানুষের দারিদ্র্য বিমোচন, সড়ক
দুর্ঘটনা প্রতিরোধ এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য এই গাছ লাগানো
হয়েছিল। গ্রামবাসী বছরের পর বছর গাছগুলোর পরিচর্যা ও পাহারা দিয়ে আসছিল।
সামাজিক বনায়নের এসব গাছ নিলামে বিক্রি করার পর পরিচর্যাকারী গরিব মানুষদের
মোট দামের ৫৫ ভাগ পাওয়ার কথা ছিল।
সাতক্ষীরা জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা আবদুল খালেক তাঁর দলের
নেতা-কর্মীদের তিন হাজারের মতো গাছ নিধনের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রথম আলোকে
বলেন, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসি রায় ঘোষণার পর তাঁর ভক্তরা গাছ কেটে
সড়ক অবরোধ করেছে। তিনি বলেন, ‘মানুষের জীবনের চেয়ে তো আর গাছ বড় না।’
জানতে চাইলে প্রধান বন সংরক্ষক ইউনুছ আলী প্রথম আলোকে বলেন, গাছ কাটার
ঘটনায় বন বিভাগ থেকে মামলা দায়ের করা হচ্ছে। হরতাল ও অবরোধ সৃষ্টিকারীরাই
গাছগুলো কেটেছে এবং সেগুলো চুরিও হয়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর
মাধ্যমে এখন তার অনুসন্ধান চলছে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ‘গাছ চুরির ঘটনায়’ ১০টি জেলায় এ পর্যন্ত মোট
৫০টি মামলা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে ৫০০ জনকে। এর মধ্যে সাতক্ষীরায় ১৫টি,
চট্টগ্রামে ১০টি, নোয়াখালীতে ১০টি, রাজশাহীতে পাঁচটি, রংপুরে ১০টি মামলা
করেছে বন বিভাগ।
বন বিভাগ এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন,
জামায়াত-শিবিরের ঘাঁটি হিসেবে চিহ্নিত এলাকাগুলোতে তাদের ভয়ে বেশির ভাগ
ক্ষেত্রে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা হয়েছে। অনেক এলাকায়
জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের কেটে ফেলে যাওয়া গাছ নিয়ে গেছে সরকারদলীয়
নেতা-কর্মীরা। ফলে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন মামলা নিতে চাচ্ছে না।
স্থানীয় লোকজনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র জানায়, সাতক্ষীরায়
জামায়াত-শিবিরের বাইরে গাছ কাটার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন শ্যামনগর ও কালীগঞ্জ
(সাতক্ষীরা-৪) আসনের সাংসদ ও জাতীয় পার্টির বহিষ্কৃত নেতা গোলাম রেজার
কর্মীরাও। তাঁরা শতাধিক গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে অবরোধ সৃষ্টি করেন।
বন বিভাগের সাতক্ষীরা জেলার একাধিক বন কর্মকর্তা জানান, ৬ মার্চের পর
পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে সাংসদ গোলাম রেজার অনুসারী জাতীয় পার্টির
নেতা-কর্মীরা গাছগুলো নিয়ে যান। স্থানীয় এলাকাবাসী বিষয়টি বন বিভাগকে
জানায়। কিন্তু এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো না থাকায় সেখানে পুলিশ বা
বন কর্মকর্তা কেউই যেতে পারেননি।
সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মনসুর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন,
‘কালীগঞ্জে গাছ চুরির সঙ্গে স্থানীয় সাংসদ গোলাম রেজার লোকজন জড়িত ছিল বলে
আমাদের কাছেও খবর এসেছে। আর জেলার অন্যান্য স্থানে জামায়াত-শিবিরের গাছ
কাটার নেতৃত্ব দিয়েছিল আগড়দাড়ি কামিল মাদ্রাসার ছেলেরা।’
গোলাম রেজা প্রথম আলোকে বলেন, বন বিভাগের কর্মীদের যোগসাজশে সুন্দরবন থেকে
প্রতিদিন হাজার হাজার গাছ চুরি হয়ে যাচ্ছে। আর তাঁরা সামান্য ৫০-৬০টা গাছ
নিয়ে মাতামাতি করছেন। তিনি বলেন, ‘আমি এখন সরকারি বা বিরোধী—কোনো দলেই নেই।
তাই আমার দিকে সবাই অভিযোগের আঙুল তুলছে।’ তিনি বলেন, ‘আমার নেতা-কর্মীরা
ওই ঘটনায় যুক্ত ছিল না।’
সাতক্ষীরা সদর, আশাশুনি ও কলারোয়ায় গাছ কাটায় নেতৃত্ব দিয়েছিল আগড়দাড়ি
কামিল মাদ্রাসার ছেলেরা। সাতক্ষীরা সদর আসনে মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির
সাংসদ আবদুল জব্বার ওই মাদ্রাসার সভাপতি।
আবদুল জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টির অনেক কর্মীর বাড়িতে হামলা
হয়েছে। আর আমি আগড়দাড়ি মাদ্রাসার সভাপতি হলেও সেখানে আমার কথায় সব কাজ হয়
না। সেখানকার কোনো ছাত্র যদি গাছ কাটা ও জামায়াতের অবরোধের সঙ্গে যুক্ত
থাকে, তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বসে আছে কেন? তাদেরকে ধরুক।’
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন, কক্সবাজার থেকে আবদুল কুদ্দুস, চট্টগ্রাম
থেকে প্রণব বল, লোহাগাড়া থেকে পুষ্পেন চৌধুরী, নোয়াখালী থেকে মাহাবুবুর
রহমান, সাতক্ষীরা থেকে কল্যাণ ব্যানার্জি, বগুড়া থেকে মিলন রহমান,
গাইবান্ধা থেকে শাহাবুল শাহীন, রাজশাহী থেকে আবুল কালাম মুহাম্মদ আজাদ ও
চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আনোয়ার হোসেন।]