শিশুদের ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার দিনভর দেশের
বিভিন্ন স্থানে গুজবের মাধ্যমে আতঙ্ক ছড়ানো হয়েছে। এ নিয়ে শিশুদের বাবা-মা ও
অভিভাবকেরা ছিলেন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়।
অনেক স্থানে গুজবে আতঙ্কিত বাবা-মা দিনে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো
শিশুকে নিয়ে সন্ধ্যা বা রাতে ছুটে গেছেন হাসপাতালে। সন্ধ্যার পর থেকে
বিভিন্ন হাসপাতালে ভিড় বাড়তে থাকে। তবে কোথাও থেকে কোনো মৃত্যুর খবর পাওয়া
যায়নি।স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছে, মানসম্পন্ন, জীবাণুমুক্ত ও সম্পূর্ণ নিরাপদ ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল গতকাল শিশুদের খাওয়ানো হয়েছে।
সন্ধ্যার পর তিন শতাধিক শিশুকে নিয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসেন শহর ও এর আশপাশের এলাকার মানুষ। রাত ১১টার দিকে হাসপাতালে শিশু ও অভিভাবকদের ছিল প্রচণ্ড ভিড়। রংপুরের সিভিল সার্জন রিয়াজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গুজবের কারণে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে শিশুদের নিয়ে আসছে।
রাত সাড়ে নয়টার দিকে প্রায় এক হাজার বাবা-মা সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে আসেন। এঁদের প্রায় প্রত্যেকের কোলে ছিল ভিটামিন ‘এ’ খাওয়ানো পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু। শিশুদের পরীক্ষা করে চিকিৎসকেরা কিছু হয়নি বলে জানান। পরে তাঁরা ফিরে যান। আরও বেশ কয়েকটি জেলা ও উপজেলা হাসপাতালেও ছিল একই অবস্থা।
রাত সাড়ে ১০টায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খন্দকার মো. সিয়ায়েত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খেয়ে দেশের কোথাও কোনো শিশু মারা যায়নি। এমনকি গুরুতর অসুস্থ হওয়ারও কোনো খবর তাঁরা পাননি। তবে ভিটামিনের সঙ্গে কিছু শিশুকে কৃমিনাশক বড়ি দেওয়া হয়েছে। ওই বড়ির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় কারও কারও বমি বা মাথা ঘোরা ভাব হতে পারে। পাতলা পায়খানাও হতে পারে। তবে ভয়ের কিছু নেই।
রাত সাড়ে নয়টায় ঢাকায় প্রথম আলোর কার্যালয়ে ফোন করে এক ব্যক্তি বলেন, ভিটামিন ‘এ’ খেয়ে গাইবান্ধায় ৩৫টি শিশু মারা গেছে। খুলনা প্রতিনিধিকে ফোন করে বলা হয়, সাতক্ষীরায় সাতটি শিশু মারা গেছে। তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসবই গুজব। এভাবে গুজব ছড়ানো হয় মুঠোফোনে, ফেসবুকে ও ব্লগের মাধ্যমে।
সিফায়েত উল্লাহ বলেন, একটি বিশেষ মহল পরিকল্পিতভাবে এ গুজব ছড়িয়েছে। স্থানীয় স্বাস্থ্য প্রশাসনের উল্লেখ করে তিনি বলেন, কক্সবাজার-টেকনাফ এলাকার রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের কাছের একটি এলাকা থেকে এই গুজবের শুরু বলে তাঁরা শুনেছেন। এ ছাড়া চট্টগ্রাম এলাকায় একাধিক মাইক ব্যবহার করে এ ধরনের প্রচার চালানো হয় বলে তাঁকে জেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
এদিকে এ গুজবে বিভ্রান্ত না হতে স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকেও মাইকিং করা হয়।
গতকাল সারা দেশে শিশুদের ভিটামিন ‘এ’ খাওয়ানো হয়। এক লাখ ২০ হাজার স্থায়ী স্বাস্থ্যকেন্দ্র ছাড়াও ২০ হাজার ভ্রাম্যমাণ কেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুদের ভিটামিন খাওয়ানোর কথা ছিল। ছয় মাস থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের ভিটামিন ক্যাপসুল ও দুই থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের ভিটামিনের সঙ্গে একটি কৃমিনাশক বড়ি খাওয়ানো হয়।
তবে হরতাল ও গুজবের কারণে কর্মসূচি বেশ খানিকটা ব্যাহত হয়েছে। অনেক কেন্দ্রে ভিড় কম ছিল। অনেকে কেন্দ্রে এসেও গুজব শুনে আতঙ্কে ভিটামিন না খাইয়েও শিশুকে নিয়ে ফিরে গেছেন।
এ কর্মসূচি তত্ত্বাবধান করা জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক এখলাসুর রহমান সন্ধ্যায় বলেন, সারা দেশে নির্বিঘ্নে শিশুদের বড়ি ও ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি সাতজন বিভাগীয় পরিচালক ও একাধিক সিভিল সার্জনের সঙ্গে কথা বলেছি। কেউ শিশুদের অসুস্থতার নজির পাননি।’
এই গুজব ছড়ায় খুলনা, সাতক্ষীরা, বগুড়া, রংপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ফেনী, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, হবিগঞ্জ, ভোলা, গাজীপুর, বাগেরহাট, কুমিল্লা, মৌলভীবাজার, শেরপুরসহ বিভিন্ন জেলায়।
বেলা একটা থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মা ও শিশু হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে অভিভাবকেরা শিশুদের নিয়ে ভিড় করেন। বন্দর এলাকার নিমতলা খালেরপাড় থেকে রেহানা বেগম ছেলে মোবিন ও মেয়ে মীমকে নিয়ে মা ও শিশু হাসপাতালে এসেছিলেন। বহির্বিভাগ থেকে বের হওয়ার সময় তিনি বলেন, ‘টিকা খেয়ে বাচ্চা মারা যাওয়ার কথা শুনে এসেছি। ডাক্তার দেখিয়েছি। কোনো সমস্যা নেই।’
মা ও শিশু হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল হক বলেন, দুপুর থেকে বহির্বিভাগে বেপারিপাড়া, নালাপাড়া, বন্দরটিলা, নিমতলা, ছোট পোল থেকে প্রায় ৭০০ শিশুকে এখানে নিয়ে আসেন আতঙ্কিত বাবা-মায়েরা। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, শিশুরা সবাই সুস্থ। এটা গুজব ছাড়া কিছুই নয়।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগেও শিশুদের নিয়ে অনেকে আসেন। চিকিৎসকেরা জানান, ওই শিশুদেরও কোনো সমস্যা নেই।
চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলায় কিছু মানুষ স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর মারমুখী হয়ে ওঠেন। অনেক জায়গায় টিকাদান কেন্দ্র লোকজন বন্ধ করে দেয়। একই গুজবে পটিয়ার শিকলবাহায় স্বাস্থ্য সহকারী জয়রাধা নাথকে বেলা তিনটা পর্যন্ত আটকে রাখে এলাকাবাসী। হাইদগাঁও আহমদ রহমান মেম্বারের বাড়িতে এক নারী স্বাস্থ্য সহকারীকে নাজেহাল করে লোকজন।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন মো. আবু তৈয়ব প্রথম আলোকে বলেন, পরিকল্পিতভাবে এই গুজব ছড়ানো হয়েছে। মারা যাওয়া দূরের কথা, কোনো শিশু অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি নেই।
সংবাদ সম্মেলন: বিকেলে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে সিভিল সার্জনের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলন হয়। এতে সিভিল সার্জন বলেন, ‘আমরা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সব টিকাকেন্দ্র এবং ১৪ উপজেলায় খোঁজ নিয়ে দেখেছি ভিটামিন ‘এ’ এবং কৃমিনাশক ওষুধ সেবনের কারণে কোথাও কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা হয়নি।’