Wednesday, March 27, 2013

বন্ধু তুমি প্রেমিক নও

অর্ণব ও সেঁজুতি (ছদ্মনাম)। স্কুলজীবন থেকেই ওদের বন্ধুত্ব। একসঙ্গে টিফিন ভাগাভাগি থেকে সুখ-দুঃখের ভাগাভাগিটা কখন যে শুরু হলো, তা কেউই টের পায়নি। এর মধ্যে হঠাৎ করেই অর্ণব টের পেল সেঁজুতিকে শুধু যেন বন্ধু ভাবতে পারছে না সে। বন্ধুত্বের চাহনিটা ক্রমেই পরিণত হয়ে উঠছে ভালো লাগায়।
একদিন বিকেলে কলেজ থেকে ফেরার পথে অর্ণব সেঁজুতিকে জানিয়ে দেয় ভালো লাগার কথা। বন্ধুর মুখে এমন কথা শুনে চমকে ওঠে সেঁজুতি। কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। বন্ধুকে যে শুধু বন্ধু হিসেবেই চায় সে, প্রেমিক হিসেবে নয়।
আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়তই ঘটছে এমন ঘটনা। কম বয়সের কোনো ছেলে বা মেয়ে ভবিষ্যতের কথা ভেবে বা বুঝে-শুনে যে বন্ধুর প্রতি ভালো লাগার কথা জানায় তা কিন্তু নয়। আবার যাকে ভালো লাগার বিষয়টি জানাচ্ছে, সেও তার মতো একই বয়সী বলে বুঝে উঠতে পারে না যে কী করবে। ‘তোমাকে না পেলে মরে যাব’ বন্ধুর এমন কথায় সে ভড়কে গিয়ে হয়তো না বুঝেই হ্যাঁ বলে ফেলে। আবার বন্ধুর পক্ষ থেকে উত্তরটি নেতিবাচক হলে ঘুমের ওষুধ খাওয়া, পরীক্ষা না দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়। অপর পক্ষের বন্ধুর মানসিক অবস্থাও যে তখন খুব স্বাভাবিক থাকে তা নয়। কারণ, সে নিজেও তার বন্ধুর ভালো চায়। তাকে হারাতে চায় না।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাহ এহসান হাবীব বলেন, ‘আমাদের জীবনে অন্যতম নিরাপদ আশ্রয়স্থল হলো বন্ধু। কৈশোরে বা কম বয়সে বন্ধুত্বকে ছাপিয়ে ভালো লাগা তৈরি হলে তখন উভয় পক্ষেরই বিষয়টি গ্রহণ ও মোকাবিলা করার মানসিক প্রস্তুতি থাকে না। ফলে না বুঝে তারা নানা রকম ভুল করে ফেলে। এ জন্য বাড়িতে এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেন সন্তান যেকোনো কথা এসে বলতে পারে। সন্তানকে ভুল না বুঝে তাকে সাহায্য করতে হবে।’
বন্ধুর প্রতি ভালো লাগা আসতেই পারে। এটি অপরাধও নয়, লজ্জা পাওয়ার মতো কোনো বিষয়ও নয়। এটি পরিবার ও শিক্ষকদের বোঝাতে হবে। তাহলে তারা সঠিক নির্দেশনা খুঁজে পাবে। বাবা-মায়ের পাশাপাশি শিক্ষকেরাও হয়ে উঠতে পারেন তাদের বন্ধু—মনে করেন সানিডেল স্কুলের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক সালমা পারভীন।
ভালো লাগার অনুভূতিটা খুব সুন্দর। আবার বন্ধুত্বের সম্পর্কটিও খুব চমৎকার। বন্ধুকে না বলা নিয়ে মনে যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়, তাকে মোকাবিলা করতে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মেহজাবীন হক। যাতে বন্ধু বুঝতে পারে একসময়ের কাছের বন্ধুটি চায় তাদের বন্ধুত্বটা টিকে থাকুক।
 কোনো বন্ধুকে বিশেষভাবে ভালো লাগলে আগে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হবে। কথাটি বলার উপযুক্ত সময় হয়েছে কি না তা বুঝতে হবে। যদি ভেবেই নেন না বলে থাকতে পারছেন না, তাহলে বলে ফেলুন। তবে এটিও মনে রাখতে হবে, যে বন্ধুকে ভালো লাগার কথা বলবেন তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা আছে। তিনি প্রেমিক হিসেবে আপনাকে নাও মানতে পারেন। এটি মেনে নেওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে।
 ভালো লাগা ভালোবাসায় জোর খাটে না, তাই বন্ধুকে কোনো প্রকার চাপ সৃষ্টি করা উচিত নয়। বন্ধুর যেকোনো সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান রেখে বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রাখা বুদ্ধিমানের কাজ।
 সবকিছু ভাবাভাবির পর ধরা যাক বন্ধুটি বলেই দিল মনের না-বলা কথা। অপর পক্ষেরও তখন বন্ধু হিসেবে কিছু কর্তব্য আছে। যেকোনো ব্যর্থতাই মেনে নেওয়া কষ্টকর। নিজের অপারগতার কথা হঠাৎ করেই রূঢ়ভাবে প্রকাশ না করে বা তাঁকে এড়িয়ে না গিয়ে স্বাভাবিক থাকতে হবে। বন্ধুকে বোঝাতে হবে এ মুহূর্তে পড়ালেখায় মনোযোগী হওয়া বেশি জরুরি।
 অন্য বন্ধুদের সামনে বন্ধুর ভালো লাগা নিয়ে হাসিঠাট্টা করা উচিত নয়। তাঁকে অপমানিত ও লজ্জিত না করে আগের মতো বন্ধু হয়ে পাশে আছেন, এটি বোঝাতে হবে।
 বন্ধুকে সময় দিতে হবে। শুধু দুজন একসঙ্গে না থেকে দলের সঙ্গে সময় কাটাতে হবে।
 বন্ধুর ভালোর জন্য সব বন্ধু মিলে আলোচনা করতে পারেন। তবে বন্ধু মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হলে মনোবিজ্ঞানীর শরণাপন্ন হতে হবে। আপনি যে তাঁর সত্যিকারের বন্ধু, তা প্রকাশ পাবে এভাবেই।