মুশফিকুর রহিমের এই সাহসটার কথা জানা ছিল না। নেটে ব্যাটিং করছিলেন। সেখান থেকে ব্যাট হাতে দৌড়ে গেলেন সাপ মারতে!
মুশফিক ভালো ব্যাটসম্যান। ভালো ছাত্র। জীবনের লক্ষ্য ভালো মানুষ হওয়া। এর
বাইরে আবেগপ্রবণ আর অভিমানী তরুণ হিসেবেই তাঁর পরিচিতি। সেই মুশফিক কলম্বোর
অনুশীলন মাঠের পাশে এঁকেবেঁকে চলে আসা সাপের মুখোমুখি হলেন ব্যাট হাতে। কী
বিস্ময়! কী বিস্ময়!
আসলে বিস্ময়ের কিছু নেই। ব্যাট নিয়ে হয়তো এর আগে কাউকে মারতে যাননি, তবে
কথার চাবুক মেরে সাহসের প্রমাণ অনেকই দিয়েছেন। সর্বশেষ ঘটনা তো
অতিসাম্প্রতিক। গল টেস্টের সাফল্যের পর ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর পুরস্কারের
ঘোষণা শুনে মুশফিক সবিনয়ে মনে করিয়ে দিলেন, এ রকম ঘোষণা প্রায়ই আসে।
কিন্তু প্রতিশ্রুত পুরস্কার আসে না। এবার সেটা এলেই তিনি খুশি হবেন।
গল টেস্টটাকে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসেই ঢুকিয়ে দিয়েছেন অধিনায়ক
মুশফিকুর রহিম। দেশের পক্ষে টেস্টে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরির ইতিহাস লেখা হলো
তাঁর ব্যাটে। অথচ পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি উচ্চতার এই তরুণকে দেখে ভেতরের সাহস
অনুমানের সাধ্য কার! বিনয়ী, মুখে অমায়িক হাসি—বাইরে থেকে এমন মুশফিককে
দেখে অভ্যস্ত সবাই। সেই মুশফিকই যখন বিপিএল নিয়ে ঠোঁটকাটা হয়ে ওঠেন,
প্রতিশ্রুতি পারিশ্রমিক না পেয়ে ধুয়ে দেন ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিককে,
অবিশ্বাস্য তো লাগেই।
গত এশিয়া কাপের আগের ঘটনা। মাত্রই শেষ হওয়া বিপিএলের প্রথম আসর নিয়ে
বিসিবির পিত্তি জ্বালিয়ে দেওয়া এক মন্তব্য করে বসলেন মুশফিক। বিপিএলের
মতো অগোছালো টুর্নামেন্ট নাকি আর হয় না। বিতর্ক আর সমালোচনায় বিপিএল
নিয়ে তখন এমনিতেই জর্জরিত বিসিবি। এ অবস্থায় জাতীয় দলের অধিনায়কের মুখ
থেকে ছুটে আসা তির সহ্য করা কঠিন। ঠোঁটকাটা মুশফিককে ‘শাসন’ করতে তাই
এশিয়া কাপে অধিনায়কত্ব কেড়ে নেওয়ারও চেষ্টা হয়েছিল তাঁর কাছ থেকে। শেষ
পর্যন্ত সফল হয়নি সে চেষ্টা।
বিকেএসপিতে পড়তেন, স্বনির্ভর হয়ে ওঠার প্রথম পাঠ সেখানেই নেওয়া। তবে
নিজের কথা স্পষ্ট করে বলার সাহস মুশফিকের চরিত্রে ঢুকে পড়েছিল আরও আগে।
চার ভাই এক বোনের মধ্যে চার নম্বর হলেও পরিবারের অনেক কিছুতেই বড়
ভাই-বোনদের কাছে গুরুত্ব ছিল তাঁর কথার। আর বগুড়ায় শৈশব-কৈশোরের বন্ধু
মহলে তো এক রকম নেতাই ছিলেন। মুশফিক কিছু বললে ফেলতে পারতেন না সমবয়সীরা।
জাতীয় দলে আসার আগে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়ক ছিলেন বলে নেতৃত্ব চর্চার
ধারাবাহিকতাটা বজায় ছিল। এখন তো জাতীয় দলেরই অধিনায়ক! ২৪ বছর বয়সী
কাঁধে ১৬ কোটি মানুষের প্রত্যাশার ভার। মুশফিককে হয়তো এই দায়িত্বই সাহসী
করে তুলেছে আরও। সে সাহসের প্রতিধ্বনি শোনা যায় ব্যাটে, কথায়।
অথচ, মুশফিকুর রহিম যেদিন অধিনায়ক হলেন, সেই রাতের সংবাদ সম্মেলনে একটা প্রশ্ন বিব্রত করল তাঁকে—
* দল হারলে বা নিজে খারাপ খেললে তো আপনি নিজেই ভেঙে পড়েন। ড্রেসিংরুমে
নাকি কান্নাকাটিও করেন। অধিনায়ক হওয়ার পরও এ রকম চললে তো নেতৃত্ব দেওয়া
কঠিন হয়ে পড়বে...।
খুবই যৌক্তিক প্রশ্ন। বাজে আউট হলে বা উইকেট কিপিংয়ে ক্যাচ-ট্যাচ ফেললে
ড্রেসিংরুমে ফিরে নিজের ওপর প্রচণ্ড অভিমানী হয়ে উঠতেন মুশফিক। কখনো হাত
দিয়ে মুখ চেপে বসে থাকতেন চুপচাপ। কখনো আটকাতে পারতেন না কান্না। দল খারাপ
খেললে সবারই মন খারাপ হয়। কিন্তু মুশফিকের আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ার মাত্রাটা
এতই বেশি হতো যে সব ফেলে তাকে সান্ত্বনা দিতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ত অনেকে।
অধিনায়ক হওয়ার পরও যদি মুশফিক এমনই থাকতেন, বাংলাদেশ দলের ড্রেসিংরুমের
অবস্থাটা কী হতো ভাবুন। খারাপ খেললে অধিনায়কের নেতৃত্বে হয়তো নিয়মিত শোক
সভাই চলত সেখানে।
অধিনায়কত্ব পাওয়ার রাতে চরিত্রের এই দুর্বলতা আড়াল করেননি মুশফিক।
প্রশ্নটা শুনে বিব্রত হলেও একগাল হাসিতে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল সেটা। স্বীকার
করেছিলেন সত্যিটা, ‘হ্যাঁ, ও রকম সময়ে আমি একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি।’
সঙ্গে প্রতিশ্রুতি ছিল, অধিনায়কত্বের বর্ম আর বাষ্পায়িত হতে দেবে না
ডুকরে ওঠা আবেগকে। ভেতরে যত ঝড়ই বয়ে যাক বাইরের ছবিটা থাকবে সাহসী
সেনাপতির। আবেগের চেয়ে দায়িত্ব বড়। সে দায়িত্ব কাঁধে নিজের তো ভেঙে
পড়ার প্রশ্নই ওঠে না, অন্যকেও ভেঙে পড়তে দেবেন না।
সাহস মুশফিককে সে রকমই এক অধিনায়ক করে তুলছে আস্তে আস্তে। এই অধিনায়ক
ব্যাট দিয়ে শুধু ডাবল সেঞ্চুরিই করে না, সাপও মারতে যায়। কথার চাবুকে
পেটায় কথার ফানুস ওড়ানোদের।