ডেসটিনি গ্রুপের পরিচালকেরা গ্রাহকদের পাঁচ হাজার ১১৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা
আত্মসাৎ করেছেন। নগদ ও চেকের মাধ্যমে এ অর্থ গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠানের
ব্যাংক হিসাব থেকে সরিয়ে নিয়েছেন তাঁরা। তবে এ অর্থ কোন কোন খাতে ব্যয় করা
হয়েছে, তার হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (এফআইইউ) বিস্তারিত
অনুসন্ধান করেও ডেসটিনির শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা অর্থ কোথায় ব্যয় করেছেন বা
পাচার করেছেন, তা উদ্ধার করতে পারেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুসন্ধানে কিছু
অর্থে জমি, প্লট ও ফ্ল্যাট কেনার হিসাব পাওয়া গেলেও অধিকাংশ অর্থের কোনো
খোঁজ নেই। তবে ডেসটিনি গ্রুপের প্রধান ব্যক্তি চেয়ারম্যান রফিকুল আমীনের
বিদেশি ব্যাংকে লেনদেন ও বিদেশে ব্যবসা রয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে সম্প্রতি ডেসটিনির অর্থ আত্মসাৎ নিয়ে
চূড়ান্ত এ প্রতিবেদন পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,
প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থের উৎস গোপন
করতে গ্রুপের পরিচালকেরা বিপুল পরিমাণ ওই অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। ডেসটিনির
মূল তিনটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড, ডেসটিনি মাল্টিপারপাস
কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড (ডিএমসিএসএল) ও ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশন। এ
তিন প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ব্যাংকের মোট ২৮২টি ব্যাংক হিসাবের তথ্য
পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, মোহাম্মদ রফিকুল আমীনের হংকংয়ের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সফটক
অনলাইন (এইচকে) লিমিটেডের মাধ্যমে ৫২ কোটি টাকা অর্থ পাচারের প্রমাণ পাওয়া
গেছে। সফটকের ৫০ শতাংশ মালিক হচ্ছেন হংকংয়ের নাগরিক নোয়েল জি ক্যারি।
ডেসটিনি গ্রুপের সব রপ্তানি সম্পন্ন হয়েছে হংকংভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটির
মাধ্যমে। এ ছাড়া সিঙ্গাপুরে রফিকুল আমীনের নামে একটি ব্যাংক হিসাব
পরিচালনার তথ্যও পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের ৬৫টি ব্যাংক হিসাবে জমা হওয়া
দুই হাজার ৮১৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে দুই হাজার ৮০০ কোটি
২৭ লাখ টাকা। ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশনের নামে করা ১৩৩টি ব্যাংক হিসাবের
৮৩৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে ৮৩০ কোটি চার লাখ টাকা।
একইভাবে ডেসটিনি কো-অপারেটিভের নামে করা ৮৪টি ব্যাংক হিসাবে জমা রাখা এক
হাজার ৪৮৪ কোটি সাত লাখ টাকা থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে এক হাজার ৪৮৩ কোটি ৫১
লাখ টাকা।
দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান প্রথম আলোকে এ বিষয়ে বলেন, ডেসটিনি নিয়ে
তদন্ত কার্যক্রম চলছে। ইতিমধ্যে এ ক্ষেত্রে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার প্রমাণ
মিলেছে। পরিচালকদের বিষয়-সম্পত্তি সব ক্রোক করার নির্দেশও পাওয়া গেছে।
সম্পূর্ণ ঘটনা জানতে হলে আরও কিছুদিন পর্যালোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। কবে
নাগাদ তদন্ত শেষ হবে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, আরও মাস খানেক সময় লাগতে
পারে। তবে এ বিষয়টি সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তাদের ওপর ছেড়ে দেওয়া ভালো
হবে।
নিজস্ব হিসাবের অর্থ: বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, অধিকাংশ
অর্থ রফিকুল আমীন ছাড়াও ডেসটিনি গ্রুপের পরিচালকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের
কর্মকর্তারা নিজের বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কোম্পানির ব্যক্তিগত হিসাবে
স্থানান্তর করেছেন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গ্রুপের প্রেসিডেন্ট লে. জেনারেল (অব.) এম
হারুন-অর-রশীদের নামে ব্যক্তি হিসাবে ১৯ কোটি ৮৩ লাখ টাকা, রফিকুল আমীন ও
তাঁর স্ত্রী ফারাহ দীবার হিসাবে ৮১ কোটি ৬৫ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। এ ছাড়া
অপর পরিচালক মোহাম্মদ হোসেনের ব্যক্তি হিসাবে এক কোটি ৯১ লাখ টাকা,
মোহাম্মদ গোফরানুল হকের ব্যক্তি হিসাব ও তাঁর নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের হিসাবে
লেনদেন হয়েছে ৮৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, মো. সাইদুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী জাকিয়া
রহমান এবং তাঁর নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের হিসাবে লেনদেন করা হয়েছে ১৭৩ কোটি ৭৪
লাখ টাকা।
এ ছাড়া মো. মেসবাহউদ্দিনের নিজস্ব হিসাবে লেনদেন হয়েছে ৭৭ কোটি ৮৫ লাখ
টাকা, শেখ তৈয়বুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী সেলিনা রহমানের হিসাবে ৩৭ কোটি ৬৩
লাখ টাকা, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনের ব্যক্তি হিসাবে ১৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকা এবং
মো. ইরফান আহমেদের ব্যক্তি হিসাবে এক কোটি আট লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। আবার
নেপাল চন্দ্র বিশ্বাস ও তাঁর স্ত্রী মিতু রানী বিশ্বাসের ব্যক্তি হিসাবে
লেনদেন ৩৪ কোটি এক লাখ টাকা, জামসেদ আরা চৌধুরীর ব্যক্তি হিসাবে ২১ কোটি ৯৫
লাখ টাকা এবং মো. ফরিদ আকতারের ব্যক্তি হিসাবে সাত কোটি ১৫ লাখ টাকা
লেনদেন হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে এসব ব্যাংক হিসাবের কোনোটাতেই ১৫ হাজার
টাকার বেশি স্থিতি নেই। অর্থাৎ সব অর্থ সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
দেউলিয়ার পথে কো-অপারেটিভ সোসাইটি: বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা
হয়েছে, কমিশন বা লভ্যাংশ দেওয়ার মাধ্যমে আমানত সংগ্রহ এবং এর উল্লেখযোগ্য
অংশ অন্য প্রতিষ্ঠানে জমা করার বিধান বিদ্যমান সমবায় সমিতি আইন, বিধি এবং
ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির নিবন্ধিত উপ-আইনে নেই। অথচ
ডেসটিনি মাল্টিপারপাস ও ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা
কমিটির সদস্য একই হওয়ায় তাঁরা মাল্টিপারপাসের নামে জনগণের কাছ থেকে সংগ্রহ
করা অর্থের মাধ্যমে সুবিধা নিয়েছেন। গ্রুপের পরিচালকেরা আইন ও বিধি লঙ্ঘন
করে ‘কমিশনের আবরণে’ নতুন উপায়ে এ বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, পরিচালকদের কারণেই ডেসটিনি মাল্টিপারপাস
কো-অপারেটিভ সোসাইটি ৯৫৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ক্ষতির সম্মুখীন, যার দায় গিয়ে
পড়ে প্রতিষ্ঠানের নয় লাখ শেয়ারহোল্ডারের ঘাড়ে। এ ছাড়া সম্পত্তি কেনার জন্য
আগাম পরিশোধ করা অর্থের বিপরীতে সম্পত্তির নিবন্ধন না হওয়ার কারণেও সমিতি
বড় ধরনের ঝুঁকির সম্মুখীন। যেমন প্রচ্ছায়া লিমিটেডকে ৭৮ কোটি টাকা দেওয়া
হয়েছে, কিন্তু সে অর্থের বিপরীতে কোনো সম্পত্তি সোসাইটির নামে নেই।
সবশেষে বলা হয়েছে, সমিতির দায়ভার অবশ্যই সমিতিকে পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু
সংগ্রহ করা অর্থের ৪৩ শতাংশ কমিশন সংগ্রহ করার সময়েই পরিচালকদের বেতন-ভাতা
বা কমিশন হিসেবে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। বাকি অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। এর ফলে
সমিতি যেকোনো সময় বিনিয়োগকারী বা আমানতকারীদের দায়দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে
দেউলিয়া হতে পারে।