হরতাল ও রাজনৈতিক সহিংসতার বলি হচ্ছে দেশের পরিবহন খাত। গত নভেম্বর থেকে ১৯
মার্চ পর্যন্ত সময়ে সারা দেশে প্রায় ৪০০ যানবাহনে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
ভাঙচুর করা হয়েছে প্রায় তিন হাজার যানবাহন। নিরাপদ বাহন ট্রেনও নাশকতার
তালিকা থেকে বাদ যায়নি। ৯২টি হামলা হয়েছে রেলের ওপর। পুলিশের ওপর হামলার
পাশাপাশি তাদের যানবাহনও পোড়ানো হয়েছে। পোড়ানো হয়েছে ফায়ার ব্রিগেডের
গাড়িও।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ),
বাস ও ট্রাক মালিক সমিতি, পত্র-পত্রিকাসহ বিভিন্ন সূত্র থেকে এ তথ্য পাওয়া
গেছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের হিসাবে গত বছরের নভেম্বর থেকে ১৮ মার্চ
পর্যন্ত ৩৫৬টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এর মধ্যে মার্চের ১৮ দিনেই
পোড়ানো হয়েছে ১২৪টি যানবাহন। এ ছাড়া ফেব্রুয়ারিতে ৭১টি, জানুয়ারিতে ৪৪টি,
গত বছরের ডিসেম্বরে ৮৩টি ও নভেম্বরে ৩৪টি যানবাহন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের হিসাবে যানবাহন পোড়ানোর ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ ১৪ কোটি ৩৩
লাখ টাকা। বাস-ট্রাক মালিক সমিতি ও বিআরটিএর করা এক হিসাবে দেখা গেছে, গত
২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে পাঁচ মার্চ পর্যন্ত চার দিনের হরতালে সারা দেশে শুধু
বাস-ট্রাক পোড়ানো ও ভাঙচুরে ১৮ কোটি টাকার সমপরিমাণ ক্ষতি হয়েছে।
ডিসেম্বর থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত ১৪ দিনে বাস পোড়ানো ও ভাঙচুরের কারণে
বিআরটিসির ক্ষতি তিন কোটি ৩৯ লাখ টাকা। বগি, রেললাইন ও স্টেশনে আগুনের ফলে ২
থেকে ১৪ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ রেলওয়ের ক্ষতি হয় নয় কোটি ৩৯ লাখ টাকার।
এর বাইরে প্রতিদিন ব্যক্তি মালিকানাধীন গাড়ি, মোটরসাইকেল, অটোরিকশা,
ইজিবাইক, কিংবা স্থানীয়ভাবে পরিচালিত বিভিন্ন যানবাহন পোড়ানো কিংবা
ভাঙচুরের শিকার হলেও সেগুলোর আর্থিক ক্ষতির হিসাব পাওয়া যায় না।
বিআরটিএ এবং বাস ও ট্রাক মালিক সমিতির হিসাবে, শুধু ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৫
মার্চ পর্যন্ত সময়েই সারা দেশে ৯৫৫টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। আগুন দেওয়া হয়
১৩০টি বাস-ট্রাকে। মূলত পত্রিকায় প্রকাশিত খবর ধরেই গত প্রায় পাঁচ মাসে তিন
হাজারের মতো গাড়ি ভাঙচুরের হিসাব পাওয়া যায়।
আর পুলিশের হিসাবে, গত সাড়ে চার মাসে তাদের ১২৯টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে।
পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ৩৭টি। জামায়াত-শিবিরের হাতে আট পুলিশ সদস্য নিহত এবং
পাঁচশ র বেশি আহত হয়েছেন।
আর ফায়ারব্রিগেড জানিয়েছে, আগুন নেভাতে গেলে তাদের চারটি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে দুটি।
পোড়ানো এবং ভাঙচুর ছাড়াও হরতাল কিংবা সহিংসতার সময় অলস বসে থাকার কারণে
বেসরকারি বাস-ট্রাক মালিকেরা দৈনিক গড়ে ৫৪ কোটি টাকা মুনাফা থেকে বঞ্চিত
হচ্ছেন বলে দাবি করেছেন। বিআরটিসির হিসাব হলো, সব গাড়ি না চললে প্রতিদিন
তারা ৩০ লাখ টাকা আয় থেকে বঞ্চিত হয়। আয় থেকে বঞ্চিত হন চালক ও শ্রমিকেরা।
এরপর গত সোমবার চট্টগ্রামে জামায়াতের ডাকা হরতালে এবং গতকাল স্বাধীনতা
দিবসেও ঢাকাসহ সারা দেশে চোরাগুপ্তাভাবে যানবাহন ভাঙচুর ও পোড়ানোর ঘটনা
ঘটেছে।
চলমান সহিংসতা যে অন্য রাজনৈতিক কর্মসূচির তুলনায় বেশি ধ্বংসাত্মক, তার
প্রমাণ মেলে বিভিন্ন স্থানে থামিয়ে রাখা গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা থেকে।
বিশেষ করে হরতাল-সমর্থকেরা আগের দিন থেকেই চড়াও হওয়ার কারণে অনেকটা
অপ্রস্তুত অবস্থায় ভাঙচুর ও আগুনের শিকার হয় যানবাহন। যাত্রীর জানমালের
পরোয়াও করছেন না এই তথাকথিত রাজনৈতিক কর্মীরা।
গত ১৮ মার্চ থেকে ৩৬ ঘণ্টার হরতাল শুরুর আগের দিন বিকেলে কল্যাণপুরে পার্ক
করা অবস্থায় সংগ্রাম পরিবহনের দূরপাল্লার একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। কোনো
রকমে দৌড়ে প্রাণ বাঁচান চালক-শ্রমিকেরা। এর আগে ঈগল পরিবহনের একটি বাস রাতে
মালিবাগে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে বাসে ঘুমিয়ে
থাকা চালকও পুড়ে মারা যান।
এভাবে যানবাহন পোড়ানো ও ভাঙচুরের ঘটনায় কত যাত্রী আহত হয়েছে, সে হিসাব কোথাও পাওয়া যায়নি।
গত বছর জানুয়ারি থেকে ১৯ মার্চ পর্যন্ত ৫৪ দিন হরতাল হয়েছে। এর মধ্যে
দেশব্যাপী হয়েছে ২৪ দিন। নভেম্বর থেকে ১৯ মার্চ পর্যন্ত পাঁচ মাসেরও কম
সময়ে হয়েছে ৩৩টি হরতাল। এই পাঁচ মাসের হরতাল কিংবা বিক্ষোভ কর্মসূচিতেই
আগুন ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। এর সবগুলোর সঙ্গেই জামায়াত-শিবির ও
বিএনপি জড়িত ছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থা দাবি
করেছে।
হরতাল ছাড়াও জামায়াত ও বিএনপির বেশ কিছু বিক্ষোভ কর্মসূচিতে সহিংসতা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
শুধু চার দিনের ক্ষতি: গত ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৫ মার্চ পর্যন্ত চার দিনের
হরতালের ক্ষয়ক্ষতির একটা হিসাব তৈরি করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতি। এই
হিসাব বিআরটিএর কাছেও জমা দিয়েছে তারা। ওই চার দিনের হরতালে সারা দেশে ৮৯টি
বাস-মিনিবাস পোড়ানো হয়। এর মধ্যে ঢাকায় ২৫টি, রাজশাহীতে ২০টি, চট্টগ্রাম ও
কক্সবাজারে ১৬টি এবং রংপুরে ১০টি। পুড়ে যাওয়া বাস-মিনিবাসের ক্ষতির পরিমাণ
প্রায় নয় কোটি টাকা। ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে ৫২৫টি এবং ক্ষতির পরিমাণ দুই কোটি
৬২ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে বাস-মিনিবাসে ক্ষতি সাড়ে ১১ কোটি টাকা।
ওই চার দিনে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান পোড়ানো হয় ৪১টি এবং ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে ৪৩০টি। ক্ষতি প্রায় ছয় কোটি ২৫ লাখ টাকা।
সব মিলিয়ে বাস-মিনিবাস ও ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান পোড়ানো এবং ভাঙচুরের কারণে চার দিনে ক্ষতি হয়েছে পৌনে ১৮ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, গাড়ি
চালালে পোড়ানো হয় কিংবা ভাঙচুরের শিকার হতে হয়। আর বন্ধ রাখলে আয় না করেই
ব্যাংকের সুদ এবং শ্রমিকের বেতন গুনতে হয়। এখন বিকল্প কিছু খুঁজে বের করতে
হবে রাজনীতিকদের।
বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির কার্যকরী সভাপতি মাহবুব চৌধুরী
বলেন, হরতালে ক্ষতি পোষানোর জন্য তাঁদের ভাড়া বৃদ্ধি করতে হচ্ছে। আগে
দিনাজপুর থেকে প্রতি বর্গফুট পাথর পরিবহন করতেন ২৫ থেকে ৩০ টাকায়। এখন ৬৫
টাকা নিতে হচ্ছে।
বিআরটিসির ক্ষতি: হরতালে বিআরটিসির বাস পোড়ানো ও ভাঙচুরের ঘটনায় ক্ষতি
হয়েছে তিন কোটি ৩৯ লাখ টাকার। এ সময়ের মধ্যে গাজীপুরের শিববাড়িতে বিআরটিসির
নতুন একটি দ্বিতল বাস পুরোপুরি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বাসটির দাম প্রায় ৮০
লাখ টাকা।
১৪ দিনে বাস চলাচল না করার কারণে লোকসানের ভারে নিমজ্জিত সংস্থাটি প্রায়
চার কোটি ৩১ লাখ টাকা রাজস্ব হারিয়েছে। ভাঙচুর, বাস পোড়ানো এবং রাজস্ব
হারানোসহ বিআরটিসির মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সাত কোটি ৭০ লাখ টাকা।
বিআরটিসির উপমহাব্যবস্থাপক খান কামাল বলেন, বিআরটিসির
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন হয় আয় থেকে। ঋণের সুদ দিতে হয় সেখান থেকেই। বাস
পোড়ানো হলে কিংবা চলাচল বন্ধ থাকলে বেতন দেওয়াও কঠিন হয়ে যায়।