Monday, March 18, 2013

‘কে জানত, এটাই হবে শেষ চুমু?’

‘প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার আগে শোভা আমাকে চুমু দিত। শনিবারও দিয়েছিল। কিন্তু কে জানত, এটাই হবে শেষ চুমু?’ গত শনিবারের দুর্ঘটনায় নিহত জান্নাতুল মাওয়া শোভার শোকসন্তপ্ত বাবা জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘মাত্র দেড় মাস আগে সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরেছি। এর মধ্যেই বড় মেয়েকে হারালাম।’
কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কের কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার হাতিমারা গ্রামে গতকাল রোববার যেন নেমে এসেছিল রাজ্যের নীরবতা। দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামে ঢোকার পথে নিহত শিশুদের স্মরণে কালো ব্যানার ঝুলিয়ে দিয়েছেন পার্শ্ববর্তী পুজকরা গ্রামের একদল তরুণ। মহাসড়ক লাগোয়া চায়ের দোকানে অন্যান্য দিনের তুলনায় মানুষের উপস্থিতি একেবারেই কম। পুরো গ্রামটিই যেন শোকে পাথর হয়ে আছে। অবুঝ সন্তানদের হারিয়ে ঘরে ঘরে কান্নার রোল উঠেছে।
‘কেমনে ওই মানিককে (রাকিব হোসেন) ভুলি থাকব। ছেলে আমার নামীদামি লোক অইত, আমার সেই স্বপ্ন ভেঙে গেল। আমার মনে হয়, ছেলে আমার কোনো জায়গায় গেছে, এখনই ফিরি আইব।’ এভাবে বলছেন আর বুক চাপড়ে বিলাপ করতে করতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন নিহত নাথেরপেটুয়া মডেল স্কুলের প্লে শ্রেণীর শিক্ষার্থী রাকিব হোসেন শুভর মা লাকি আক্তার।
শনিবার কুমিল্লার মনোহরগঞ্জের নাথেরপেটুয়া এলাকায় ট্রাকচাপায় সাত শিক্ষার্থী নিহত হয়। তাদের মধ্যে ছয়জন হাতিমারা ও একজন কাউলিপাড়া গ্রামের। সাত খুদে শিক্ষার্থীকে হারিয়ে হাতিমারা গ্রামের ঘরে ঘরে চলছে মাতম।
শিক্ষার্থীদের স্মরণে তিন দিনের শোক ঘোষণা করেছে মনোহরগঞ্জ উপজেলা পরিষদ। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে কালো ব্যাজ ধারণ ও কালো পতাকা উত্তোলন। নিহত ফাহাদুল ইসলাম মিথনের ভাই নাসির উদ্দিন বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ট্রাকচালকের বিরুদ্ধে গতকাল মনোহরগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
লাকসাম-নোয়াখালী রেললাইন পার হয়ে প্লে শ্রেণীর শিক্ষার্থী রাকিব হোসেন ও মোক্তাকিম হোসেন হূদয়, নার্সারি শ্রেণীর শিক্ষার্থী আল আমিনের বাড়ি। একই বাড়ির তিন শিক্ষার্থীকে হারিয়ে ঘরে ঘরে কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে আল আমিনকে হারিয়ে তার বাবা আবদুল মালেক ও আয়েশা বেগম পাগলপ্রায়। মোক্তাকিম হোসেনের বাড়ি পার্শ্ববর্তী কাউলিপাড়া গ্রামে। নানার বাড়ি হাতিমারা গ্রামে থেকে পড়াশোনা করত মোক্তাকিম। চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থী টিপু সুলতান ওরফে স্বাধীনের মা সুরমা বেগম বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে তিনি খাটের মধ্যে গড়াগড়ি করছিলেন। তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী ফাহাদুল ইসলামের মা নাছিমা আক্তার ও বাবা মাহবুব আলম ছেলের বই নিয়ে খাটের মধ্যে বসে আছেন।
ফাহাদুলের মা নাছিমা আক্তার বলেন, ‘প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার আগে বলতাম, আল্লাহর আমানত, আল্লাহর হাওলা করে দিলাম। এ কেমন বিচার হলো।’
প্লে শ্রেণীর শিক্ষার্থী হাসিবুল হাসান নিহাদ তিন বোনের একমাত্র ভাই। দুর্ঘটনায় হাসিবুল মারা যায়। ওই দুর্ঘটনায় তার ছোট বোন ফাহমিদা তাহের তমা আহত হয়।
সংশোধনী: মনোহরগঞ্জের নাথেরপেটুয়া এলাকায় শনিবারের সড়ক দুর্ঘটনায় আট শিক্ষার্থী নিহতের খবর গতকাল প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছে। তাদের মধ্যে নাসির উদ্দিন নামের তৃতীয় শ্রেণীর একটি শিশুর মৃত্যুর কথা উল্লেখ করা হয়। প্রকৃতপক্ষে ওই নামে কেউ ভ্যানে ছিল না বলে জানিয়েছেন নাথেরপেটুয়া মডেল স্কুলের অধ্যক্ষ আমিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, নিহত শিশুদের প্রকৃত সংখ্যাটি হবে সাত।
মনোহরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জহিরুল আনোয়ারও এই সংখ্যাটির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।