‘আমরা করব জয়’ গাইতে সোহাগ গাজীকে একটুও অপেক্ষা করতে হয়নি। ওয়ানডে
অভিষেকেই ড্রেসিংরুমে সুর মিলিয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বিজয় সংগীতের
সঙ্গে। পরের ম্যাচে আবারও। তার পরও শ্রীলঙ্কায় এসে ‘আমরা করব জয়’ গাইতে
পারার মহিমাটা আলাদা হয়ে ধরা দিচ্ছে এই অফ স্পিনারের কাছে, ‘কী যে ভালো
লেগেছে, বলে বোঝাতে পারব না।’
শেন জার্গেনসেনও ‘আমরা করব জয়’ গাইতে শিখে গেছেন। চর্চা করার সুযোগ যে খুব
ঘন ঘনই মিলছে! বাংলাদেশ দলের অস্ট্রেলিয়ান কোচের এখন পর্যন্ত দুর্দান্ত
রেকর্ড। প্রথম সিরিজেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তিনটি জয়। শ্রীলঙ্কায় প্রথম
সাফল্যের ইতিহাসেও লেখা থাকল তাঁর নাম। কাল দুপুরে টিম হোটেলে হাসতে হাসতে
বললেন, ‘কথা-টথা বোধ হয় ভুল হয়ে যায়, তবে দলের সঙ্গে আমিও গলা ছেড়ে গাই।’
একটা সুবিধা তো আছেই। কথা আলাদা হতে পারে, সুরটা তো বিশ্বজনীন। ‘উই শ্যাল
ওভারকাম’ তো কতই গেয়েছেন জীবনে! একজন কোচের জীবনে সবচেয়ে বড় আনন্দ হলো
খেলোয়াড়দের ভালো করতে দেখা, জয় যেটির চূড়ান্ত পুরস্কার। জয়ের প্রতিক্রিয়া
থেকে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের মধ্যে পরিবর্তনটাও খুব ভালো বুঝতে পারছেন
জার্গেনসেন, ‘আগে জেতার পর খেলোয়াড়েরা যেন বুঝতে পারত না, কী করবে। এখন
উদ্যাপনটা খুব স্বতঃস্ফূর্ত হয়। কাল (পরশু) তো ড্রেসিংরুমে আমরা কোচিং
স্টাফরাও ইচ্ছামতো লাফালাফি করেছি।’
তা লাফালাফি করার মতোই এক জয়। শ্রীলঙ্কায় এর আগের সব কটি সফর যেখানে লজ্জা
আর লাঞ্ছনার প্রতিশব্দ হয়ে আছে, সেখানে এসে এবার ওয়ানডে সিরিজে ড্র। বৃষ্টি
হয়তো আশীর্বাদ হয়েই এসেছিল, তার পরও ৮০ বলে ১০৫ রানও একেবারে সহজ ব্যাপার
ছিল না। আবেগের আতিশয্যে মুশফিকুর রহিম যে এটিকে ‘দেশের বাইরে বাংলাদেশের
সবচেয়ে বড় জয়’ বলে ফেললেন, সেটি নিয়েও তাই ভ্রু কোঁচকানোর কিছু নেই। এই
দিনে কোনো কিছুই ধরতে নেই। নইলে মুশফিকুরকে কার্ডিফের কথা মনে করিয়ে দেওয়া
যেত। পোর্ট অব স্পেন বা গায়ানার কথাও।
২০০৫ সালে কার্ডিফের জয়টা এমন এক সময়ে, অস্ট্রেলিয়াকে যখন অন্য দলগুলো শুধু
স্বপ্নেই হারাতে পারত। ২০০৭ বিশ্বকাপে পোর্ট অব স্পেনে ভারতের বিপক্ষে
জয়টা তো সম্ভবত বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে তাৎপর্যময়। সেই জয়ের
তরীতে ভেসে সুপার এইটে গিয়ে গায়ানায় যখন গ্রায়েম স্মিথের দলকে হারাল
বাংলাদেশ, দক্ষিণ আফ্রিকা তখন ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বর।
কার্ডিফের রূপকথা ড্রেসিংরুম থেকে দেখেছেন। তবে পোর্ট অব স্পেন ও গায়ানায়
মাঠেই জয়োল্লাস করেছেন মুশফিকুর নিজেও। সেসব ভুলে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে
জয়টাকে এক নম্বর বলে ফেলার কারণ হয়তো একটাই—শ্রীলঙ্কায় এর আগে কখনোই কিছু
জিততে না পারা।
২০০৬ সালে বাংলাদেশ সফরের সময় সনাৎ জয়াসুরিয়া বাংলাদেশ কোন কোন বড় দলকে
হারিয়েছে শোনার পর গর্ব করে বলেছিলেন, ‘তোমরা এখনো আমাদের হারাতে পারোনি।’
নিয়তির কী খেলা, সেই সিরিজেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম জয়। সাত
বছরের মধ্যে শ্রীলঙ্কা বলতে গেলে বাংলাদেশের প্রিয় প্রতিপক্ষে পরিণত! বড়
দলগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কাকেই সবচেয়ে বেশিবার হারিয়েছে বাংলাদেশ। গত পরশুর আগ
পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার সঙ্গী ছিল ভারত। এখন বাংলাদেশের ‘দৈত্য বধ’-এর তালিকায়
শ্রীলঙ্কার নাম আসছে চারবার। তিনবার ভারতের।
‘দৈত্য বধ’ কথাটাও বোধ হয় এখন আর খাটছে না। আবদুর রাজ্জাক তো বলেই দিলেন,
‘ওয়ানডেতে এমন কোনো দল নেই, যাদের আমরা হারাতে পারি না।’ শ্রীলঙ্কার
বিপক্ষে আগের তিনটি জয়ের প্রথম দুটিতে ছিলেন না। ২০০৯ সালের দ্বিতীয় জয়ের
সময় বোলিং অ্যাকশনের কারণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিষিদ্ধ ছিলেন। তাই তাঁর
আনন্দটা একটু বেশি, ‘৫ উইকেট পেলাম। ২০০ উইকেটও হলো। টিমও জিতল। এই ম্যাচ
থেকে আমি আর কীই-বা চাইতে পারতাম!’
মুশফিকুর রহিম এশিয়া কাপের সাফল্যভাস্বর ২০১২ শেষ হওয়ার পর নতুন বছরের
লক্ষ্য ঠিক করেছিলেন দেশের বাইরে ভালো খেলা। বছরের প্রথম সফরেই সেই লক্ষ্যে
যাত্রায় অবিস্মরণীয় এক সূচনা। প্রথমবারের মতো শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট
ড্র, শ্রীলঙ্কায় প্রথম শ্রীলঙ্কা-বধ—আগামীকালের টি-টোয়েন্টিটাও জিতে গেলে
হয়েই গেল!
তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডের মাহাত্ম্য তো শুধু জয়ে শেষ নয়, টি-টোয়েন্টির প্র্যাকটিসটাও তো সেরে ফেলা গেছে তাতে!