‘বিরোধীদলীয় নেতা সংসদ অকার্যকর করার জন্য জোট সরকারকে অভিযুক্ত করেন। তিনি
সতর্ক করেন যে সংস্কার করা ছাড়া নির্বাচন হবে না। তিনি আগামী নির্বাচনে
কারচুপির পরিকল্পনা পরিত্যাগ করতে ক্ষমতাসীনদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি
থাইল্যান্ডের সামরিক অভ্যুত্থান থেকে শিক্ষা নিতে এবং “ক্ষমতার লোভে”
সংসদীয় সরকারব্যবস্থা ধ্বংস না করার আহ্বান জানান। বিরোধীদলীয় নেতা অবশ্য
বাংলাদেশে থাই রাজনীতির পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা নাকোচ করেন।’
বাংলাদেশের বিরোধী দলের নেতা এই উক্তি করেছিলেন সংসদে, ২০০৬ সালের ৪
অক্টোবর। আজ তিনি প্রধানমন্ত্রী। অথচ ওই মন্তব্য আজকের বিরোধী দলের নেতার
বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এর অর্থ, সাত বছর আগে ও পরের রাজনৈতিক অবস্থার কোনো
মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি। এ প্রসঙ্গের অবতারণা সেনাবাহিনীকে নিয়ে খালেদা জিয়ার
অনভিপ্রেত উক্তির কারণে। তিনি বলেছেন, ‘সেনাবাহিনীরও দেশের প্রতি কর্তব্য
আছে। তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করবে না। মানুষ খুন করবে আর তারা চেয়ে
চেয়ে দেখবে। কাজেই সেনাবাহিনী সময়মতোই তাদের দায়িত্ব পালন করবে।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়েরের হুমকি সম্পর্কে
ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেছেন, এটা তো রাজনৈতিক। সাবেক সেনাপ্রধান লে. জে.
(অব.) মাহবুবুর রহমানও বলেন এটা তো ‘রাজনৈতিক’। এটা আসলে একটা
স্বীকারোক্তি যে, রাজনীতি কতটা দায়িত্বহীন কিংবা ভয়ানক। অবশ্য এ নিয়ে উভয়
পক্ষের বাক্যবাণ বিনিময় পরিণামে শূন্যগর্ভ। কিন্তু যা অশুভ তা হলো,
মাত্রাভেদে উভয় বিবদমান পক্ষ ক্রমশ সেনাবাহিনীকে বিতর্কের কেন্দ্রে টানার
জোরালো প্রবণতা দেখাচ্ছে। নির্বাচনকালে সেনার ভূমিকা নিয়ে এই তর্ক আরও
উত্তাপ সৃষ্টি করতে পারে।
থাইল্যান্ডের নির্বাচিত সরকারের অপমানিত হওয়া থেকে আমাদের রাজনীতিকেরা কী
শিখেছেন? থাই অভ্যুত্থান ঘটে ২০০৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। ক্ষমতাচ্যুত
প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার জনপ্রিয়তা কম ছিল না। অথচ পাঁচ বছরের
মেয়াদ পুরো করার আগেই তিনি বিতর্কিত হন, দুর্নীতিগ্রস্তের তকমা তাঁর ললাটে
অঙ্কিত হয়। বৌদ্ধ-অধ্যুষিত দেশটির প্রথম মুসলিম সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল
সোনধিকে নিয়োগ করে থাকসিন প্রশংসা কুড়ান। অথচ এই জেনারেলই তাঁকে অপসারিত
করেন। কিন্তু ক্ষমতার লোভেই তিনি তা করেছিলেন, সেই অভিযোগ জোরালো হয়নি। বলা
হয়, থাই ক্যু আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার মতো সহিংস নয়। মৌলিক অধিকারও খর্ব
করে না।
ব্যাংককে যেদিন সেনা অভ্যুত্থান ঘটে, প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সেদিন
টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে সেনানিবাসে বক্তব্য দিচ্ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, শুধু
বাইরে থেকে নয়, দেশের ভেতর থেকেও স্বাধীনতার ওপর আঘাত আসতে পারে। সংঘাত,
নৈরাজ্য ও বিভ্রান্তির কারণে এই হামলা হতে পারে। তিনি এ জন্য সেনাবাহিনীর
সদস্যদের সার্বক্ষণিক সতর্ক থাকার জন্য আহ্বান জানান। প্রথম আলোর প্রথম
পাতায় ২০ সেপ্টেম্বর ২০০৬ থাইল্যান্ডে সামরিক অভ্যুত্থান শিরোনামে যে খবরটি
ছাপা হয়েছিল, তার ঠিক পাশের শিরোনামটি ছিল ‘বিচারপতি হাসানের বাসায় কড়া
পাহারা’। বিচারপতি কে এম হাসানকে মানতে পারেনি আওয়ামী লীগ। এর চূড়ান্ত
খেসারত হলো শেখ হাসিনার সম্মতিতে সৈয়দ আবুল মকসুদ বর্ণিত ‘তিনোদ্দীন’
সরকারের উত্থান।
খালেদা জিয়াকে থাই অভ্যুত্থান থেকে শিক্ষা নেওয়ার যে আহ্বান তখনকার
বিরোধীদলীয় নেতা এবং আজকের প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, তা যথার্থ ছিল বৈকি।
সেনা দ্বারা নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর অপদস্থ হওয়া কারও কাম্য নয়। কিন্তু
‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ থাকসিনের জন্য থাইল্যান্ড কান্না করেনি। সাবেক
প্রধানমন্ত্রী চুয়ান লিকপাই মন্তব্য করেছিলেন, ‘রাজনীতিক হিসেবে আমরা কোনো
ধরনের ক্যু সমর্থন করতে পারি না। কিন্তু গত পাঁচ বছরে থাকসিন এমন কতিপয়
অবস্থার সৃষ্টি করেছেন, যা সামরিক বাহিনীকে অভ্যুত্থান ঘটাতে বাধ্য করে।
থাকসিনই সংকট সৃষ্টি করেছেন।’ খালেদা জিয়া ও থাকসিনের আসা-যাওয়ার মধ্যে বেশ
মিল ছিল। শেখ হাসিনা তা ধরতে পেরেছিলেন।
থাইল্যান্ডের শ্রদ্ধাভাজন বুদ্ধিজীবী আনন্দ পেনিয়ারাচুন। র্যামন
ম্যাগসাইসাই পুরস্কারপ্রাপ্ত আনন্দ একবার নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক
সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি অনেকটা থাইল্যান্ডের বিচারপতি
সাহাবুদ্দীন। থাকসিনের ক্ষমতাচ্যুতিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখেছেন আনন্দ। ফার
ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘১৯৯২ সাল থেকে
থাইল্যান্ড চারটি সাধারণ নির্বাচন দেখেছে। অভ্যুত্থানের কোনো চিন্তা বা
গুজব মিলিয়ে গিয়েছিল। সেনারা ব্যারাকে ফিরেছিল। এবং তারা সত্যিকারের
পেশাদার সেনা হয়ে উঠছিল। এ অবস্থায় যে অভ্যুত্থানটা ঘটল, তার কারণ সরকার
একটা চরম দুর্ভাগ্যজনক অবস্থা ডেকে এনেছিল, বেরোনোর রাস্তাটা শেষ হয়ে
গিয়েছিল।’ ২৫ সেপ্টেম্বর ২০০৬ নিউজ উইককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তাঁর আরও
মন্তব্য ছিল, ‘গত পাঁচ বছরে থাকসিন ও তাঁর দল প্রবল প্রতাপশালী হয়ে উঠেছিল।
সমগ্র সরকারি যন্ত্র ও সশস্ত্র বাহিনী এবং পার্লামেন্টের কতিপয় মহলের ওপর
থাকসিন তাঁর কর্তৃত্ব সংহত করেছিলেন। সুতরাং আমি মনে করি, একটি অধিকতর
আশঙ্কাজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল।’
থাইল্যান্ডের চেয়ে বাংলাদেশ নির্বাচিত সরকারের ধারায় পুনরায় ফিরে আসতে কম
সময় নিয়েছে। থাকসিন ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থাই রাজনীতিতে পাগলা ঘণ্টা বেজেই
চলছিল। কেবল ২০০৮ সালই চারজন প্রধানমন্ত্রী প্রত্যক্ষ করে। এঁদের তিনজনই
এসেছেন সাংবিধানিক আদালতের ডিক্রিতে। থাকসিনের আর ফেরা হয়নি। জনপ্রিয়তার
মানদণ্ডই নির্বাচিত নেতা হিসেবে দীর্ঘকাল টিকে থাকার রক্ষাকবচ নয়। থাকসিন
ক্ষমতাই শুধু হারাননি, দলও হারিয়েছেন। নির্বাচনে কারচুপির দায়ে আদালত
থাকসিনসহ ১১১ জন বড় নেতা ও তাঁদের দলকে পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছেন।
থাকসিনের অনুসারীরা দুবার দল পাল্টিয়ে ২০১১ সালে একটি নতুন দল নিয়ে জয়ের
মুখ দেখলেন। থাকসিনের ছোট বোন ২০১১ সালে দেশটির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী
হন।
দুর্নীতির কালিমা নিয়ে থাকসিন রাজনীতিতে পরিত্যক্ত। বাংলাদেশের নেতা হলে
তিনি উতরে যেতেন। এখানে কালি মুছতে বেশি সময় লাগে না। প্রধানত খালেদা জিয়ার
অপরিণামদর্শিতার কারণে সেনা হস্তক্ষেপ অনিবার্য হয়েছিল। এর পরের ছয়-সাত
বছরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন কিছু ঘটেনি, যাতে বিরোধীদলীয় নেতার উল্লিখিত
মূল্যায়ন কোনো সরকারপ্রধানের জন্য একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল ও বিচারকদের বয়স বাড়ানোর সংশোধনীর চেতনা অভিন্ন।
সেটা ক্ষমতা। ‘ক্ষমতার লোভ’। রাজনীতিকেরা সেটা স্বীকার করবেন না। বরং মওকা
বুঝে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাতেই তাঁরা ও তাঁদের চাটুকাররা সিদ্ধহস্ত।
এটা খুবই চিন্তার বিষয় যে সশস্ত্র বাহিনীকে ক্রমাগত রাজনৈতিক আলোচনার
বিষয়বস্তুতে পরিণত করা হচ্ছে। এই দুর্মতির দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। মেঠো
বক্তৃতায় কে কত বেশি ক্ষতিকর ভূমিকা রেখেছে, তার একটা প্রতিযোগিতামূলক
ফলাফল গবেষণার বিষয় হতে পারে। কিন্তু এ ধরনের মেঠো বক্তৃতার সূচনা করার
সুযোগ হাতছাড়া না করা এবং তা থেকে সুবিধা নেওয়ার ঝোঁক বা প্রবণতার লাগাম
টেনে ধরার সংযম আমরা দেখি না। গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা সেনানিবাসে দেওয়া
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলাজনিত ছিল বলেই
প্রতীয়মান হয়। তাঁর কিছু বক্তব্য ছিল কেবল জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের
জন্য প্রযোজ্য। যেমন ‘কনিষ্ঠ কর্মকর্তারা যাতে কোনো অপপ্রচারের শিকার না
হন, সে জন্য জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাদের হুঁশিয়ার’ করে দেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, কনিষ্ঠদের ‘শ্রদ্ধা ও আনুগত্য জ্যেষ্ঠদের অর্জন করতে হবে।’ এ
ধরনের বিবৃতি জনসমক্ষে আসার কোনো প্রয়োজন ছিল না।
অতীতেও আমরা দেখেছি, সেনানিবাসে আয়োজিত পেশাদারি অনুষ্ঠানে সরকারপ্রধানেরা
পরোক্ষভাবে হলেও দলীয় প্রতিপক্ষের উদ্দেশে ইঙ্গিত দিয়ে থাকেন। যেমন
প্রধানমন্ত্রী ওই সমাবেশে আশা প্রকাশ করেন যে সেনাবাহিনী তাদের সর্বশক্তি
দিয়ে যেকোনো ‘অসাংবিধানিক কিংবা অগণতান্ত্রিক কার্যক্রম’ প্রতিহত করবে।
তাঁর আহ্বান ছিল ‘সর্বোচ্চ সতর্কতায় নিজেদের সজাগ রাখুন, যাতে সেনাবাহিনীর
ওপর ভর করে কেউ ক্ষমতা দখল করতে না পারে।’
তারিখটি মনে নেই। সময়টা ১৯৯৪-৯৫ সাল হবে। সিলেটের এক জনসভায় দেওয়া আওয়ামী
লীগের নেতাদের বক্তব্যের বরাত দিয়ে ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি একটি
প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেই খবরটিও সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে ছিল।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার না দিতে অনমনীয় বিএনপিকে ঘায়েল করতে সেটাও একটা
‘উসকানি’ ছিল। খবরটি বিদেশি একটি পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয়েছিল এবং সেটির
ক্লিপিং সম্ভবত হংকং মিশন থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। বিস্মিত
লেখক আওয়ামী লীগের একজন বড় নেতার কাছে জানতে চান, এটাই কি আওয়ামী লীগের
অবস্থান? তিনি ত্বরিত উত্তর দেন: আলবৎ! মির্জা ফখরুলের মতো বলেননি, উসকানি
নয়, প্রশংসা।
বগুড়ায় বিএনপি নেত্রীর দায়িত্বহীন উক্তির পর তাঁদের পলায়নপরতা দেখার মতো।
অথচ এখানে অনুশোচনার কিছু নেই! জাতীয় ভান্ডার তো মহাসমৃদ্ধ। প্রতিপক্ষের
ভান্ডার থেকে এ রকমের বা কাছাকাছি কোনো দৃষ্টান্ত খুঁজে বের করলেই হলো।
খারাপের সঙ্গে খারাপের তুলনার একটা আত্মঘাতী প্রক্রিয়া চলছে। ভারপ্রাপ্ত
মহাসচিবের ভারে চিড়েচ্যাপ্টা মির্জা ফখরুল বেচারা। কেমন ডাহা মিথ্যা বলছেন।
তবে প্রহসনের বিষয়, বিএনপির চেয়ারপারসনের নিন্দনীয় উসকানির দায়ে
রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়েরে প্রধানমন্ত্রীর জ্ঞাতসারে কিংবা কথিতমতে
অনাগ্রহী প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিচ্ছেন সেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি
তথাকথিত ‘জনতার মঞ্চের’ অনুঘটক। সেখানে অবশ্যই ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ গুরুতর
উপাদান ছিল। এর সবটাই ‘রাজনৈতিক’ তবে সমাজ-রাষ্ট্রের জন্য বিষাক্ত। আশা
করব, সব পক্ষই সেনাবাহিনীকে নিয়ে রাজনৈতিক মেঠো বক্তৃতা পরিহার করবে। এর
আগে ব্যর্থ ক্যু চেষ্টার সঙ্গে বিএনপিকে কেবলই মেঠো বক্তৃতায় অভিযুক্ত করতে
দেখা গেছে। কোথাও আইনের লঙ্ঘন হলে আইনের স্বাভাবিক গতিতে তার প্রতিকার
হোক। কিন্তু বক্তৃতাবাজি পরিবেশ দূষিত করে। সেনাবাহিনীকে অহেতুক বিব্রত
করে।