Wednesday, March 6, 2013

৫৬ বছর পর শ্বশুরবাড়িতে প্রণব তেষ্টা মেটালেন ডাবের জলে

নড়াইল থেকে: দিল্লি থেকে ঢাকা। তারপর শ্বশুরবাড়ি নড়াইলের ভদ্রবিলা। নিরাপত্তায় নেয়া হয় বাড়তি ব্যবস্থা। জলপানের নানা আয়োজন। জামাইবাবু যে ভারত অধিপতি। ভদ্রবিলার গৌরব আর অহঙ্কার। শ্বশুরবাড়ি বসে তেষ্টা মেটালেন ডাবের জলে। তারপর স্বাদ নিলেন কুলের। শ্বশুর পক্ষের লোকজন তাকে আপ্যায়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের ফলমূলসহ দেশীয় বিভিন্ন ধরনের খাবারের আয়োজন করেছিলেন। কিন্তু তিনি ডাবের জল এবং কুল বরই ছাড়া আর খিছু খাননি। কুল খেতে খেতে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে আলাপচরিতায় মেতে উঠেন। প্রথমেই শ্বশুরবাড়ির পারিবারিক মন্দিরে পূজা দেন। এরপর ওই বাড়িতে তৈরি করা মঞ্চে উঠে আত্মীয়দের উদ্দেশে কথা বলেন। প্রেসিডেন্টের আত্মীয়-স্বজনরা জানায়, প্রণব মুখার্জি নড়াইল সদর উপজেলার চাঁচড়া গ্রামে মামা শ্বশুরবাড়ি একটি মন্দির করে দেয়ার ঘোষণা দেন। শ্বশুরবাড়ির মন্দিরে পূজা-অর্চনাসহ শ্বশুরকুলের স্বজনদের সঙ্গে একান্তে ৫০ মিনিট সময় কাটান প্রণব ও তার স্ত্রী শুভ্রা। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ, তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মোস্তফা ফারুকী মোহাম্মদ, ডিসি জহুরুল হক, জেলা পরিষদ প্রশাসক এডভোকেট সুবাস বোসসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ। বিয়ের ৫৬ বছর পর এ প্রথমবারের মতো তিনি গতকাল সস্ত্রীক শ্বশুরবাড়ি বেড়িয়ে গেলেন। সঙ্গে তাদের পালিত কন্যাও ছিল। এতকাল পরে জামাইবাবু ও বোন শুভ্রা মুখার্জিকে কাছে পেয়ে আবেগ আপ্লুত ছোটভাই কানাইলাল আনন্দ অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। জামাইবাবু প্রণব মুখার্জি ও বোন শুভ্রা মুখার্জি কানাইলালকে সান্ত্বনা দেন। তারা জানিয়েছেন সময় কম তাই বেশি সময় থাকা যাচ্ছে না। তবে ভাগ্যে থাকলে আবার দেখা হবে এমনটাই জানিয়েছেন। কানাইলাল তাদের রিসিভশন জানানোর জন্য সকাল থেকে প্রস্তুতি নিয়ে অধির আগ্রহে বাড়িতেই ছিলেন। ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি সস্ত্রীক হেলিকপ্টারযোগে সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে নড়াইল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অবতরণ করেন। ডিসি জহুরুল হক তাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন নড়াইল-১ আসনের সংসদ সদস্য কবিরুল হক মুক্তি, নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্য এস কে আবু বাকের, সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য ফরিদা রহমান ও ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পী ও পুলিশ সুপার সরদার রকিবুল ইসলাম। প্রণব মুখার্জি সস্ত্রীক সেখান থেকে সড়ক পথে শ্বশুরালয়ে যান। অন্য একটি হেলিকপ্টারে ২৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধি (ডেলিগেট) দল নড়াইল শহরের কুড়িগ্রাম হলিপ্যাডে অবতরণ করেন। বেলা  ১১টা ২৭ মিনিটে শ্বশুরবাড়ি পৌঁছান বিশাল গাড়িবহর নিয়ে। গাড়ি বহরে এসএসএফ, দেশীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ি, ডিসি-এসপির গাড়ি, প্রটোকলের গাড়িসহ মোট ৩২টি গাড়ি ছিল। হু হু করে সাইরেন বাজিয়ে নড়াইলের এস এম সুলতান চিত্রা সেতু পার হয়ে গাড়িগুলো চলে যায় ভদ্রবিলা গ্রামে। রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে ছিল হাজারো কৌতূহলি মানুষ ভারতের প্রেসিডেন্টকে এক নজর দেখার জন্য। কিন্তু সে সুযোগ কারও ভাগ্যে জোটেনি। তিনি যে গাড়িতে ছিলেন। গাড়িটি ছিল কালো রঙের। গ্লাসের রং ছিল কালো। বাংলাদেশ ও ভারতের পতাকা দেখে সাধারণ মানুষ অনুমান করেন এ গাড়িতে প্রেসিডেন্ট আছেন। প্রেসিডেন্টের হেলিকপ্টার নড়াইলে অবতরণের সঙ্গে সঙ্গে নড়াইলের প্রধান প্রধান সড়কের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। হেলিকপ্টারে উঠার পর আবার যান চলাচল শুরু হয়। প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি বেলা ১২টায় ভদ্রবিলা শ্বশুরবাড়ি হতে বের হন। সড়ক পথে সোজা চলে আসেন হেলিকপ্টারের কাছে। ১২টা ৪৩ মিনিটের সময় তাকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি কুষ্টিয়ার শিলাইদহে যাওয়ার উদ্দেশে আকাশে উড়ে। প্রেসিডেন্ট ১ ঘণ্টা ৫৩ মিনিটের সফরে সার্বিক ব্যববস্থাপনায় ছিল জেলা প্রশাসন। তাদের নিরাপত্তার সার্বিক দায়িত্বে ছিল এসএসএফ। হরতালসহ বর্তমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির বিষয় মাথায় রেখে মোতায়েন করা হয় দুই প্লাটুন বিজিবি, পুলিশ, আর্মড পুলিশ, র‌্যাবসহ অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিপুলসংখ্যক সদস্য, ডগ স্কোয়াড ও নৌ ডুবুরি। সুদীর্ঘ বিবাহিত জীবনে এ প্রথম সদর উপজেলার ভদ্রবিলা গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে পদচিহ্ন দিলেন বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান।
৩ দিনের সফর শেষে ফিরে গেলেন ভারতের প্রেসিডেন্ট
কূটনৈতিক রিপোর্টার জানান, ঢাকায় রাষ্ট্রীয় সফর শেষে দেশে ফিরে গেছেন ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি। সফরের তৃতীয় ও শেষ দিনে রাজধানী ঢাকা, নড়াইলের শ্বশুরালয়, কুষ্টিয়ায় কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত শিলাইদহ কুঠিবাড়ী ও টাঙ্গাইলের ভারতেশ্বরী হোমস-এ ব্যস্ত সময় কাটিয়ে গতকাল সন্ধ্যায় দিল্লির উদ্দেশে রওনা হন। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের মন্ত্রী-উপদেষ্টা ও পদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা হজরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে বিদায় জানান। রোববার দুপুরে ফার্স্ট লেডি বাংলাদেশের মেয়ে শুভ্রা মুখার্জিসহ ৯০ সদস্যের প্রতিনিধি দল নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন ভারতের প্রথম বাঙালি প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথম বিদেশ সফরে বাংলাদেশে আসা বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী প্রণব মুখার্জি এখানে অবস্থানকালে প্রেসিডেন্ট মো. জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন। এছাড়া, জাতীয় সংসদের স্পিকার আবদুল হামিদ এডভোকেট, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, পররাষ্ট্রমন্ত্রী  ডা. দীপু মনি, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, তথ্য মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, প্রধানমন্ত্রীর দুই উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান ও ড. গওহর রিজভী, সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইদুজ্জামান এবং সপরিবারে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সফরকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম সমাবর্তনে তাকে সম্মানসূচক ডক্টর অব ল’ ডিগ্রি দেয়া হয়। তিনি সমাবর্তন বক্তা হিসেবে সেখানে গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতাও করেন। এছাড়া, মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী যৌথভাবে তার হাতে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ তুলে দেন। ভারতের প্রেসিডেন্ট ও ফার্স্ট লেডি তাদের সম্মানে আয়োজিত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ভোজে যোগ দেন। তিনি ঢাকাস্থ ভারতীয় নাগরিকদের সঙ্গেও মতবিনিময় করেন। ঢাকায় শত ব্যস্ততার মাঝেও ব্যাংককে চিকিৎসাধীন ড. কামাল হোসেনের মতো সুহৃদের খোঁজখবর নিতে ভুলেননি প্রণব মুখার্জি। সফরকালে ভারতীয় প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সাক্ষাতের কথা থাকলেও পরে তার দলের তরফে তা বাতিল করা হয়।
ঢাকায় রেল ইঞ্জিন উদ্বোধন: রেলওয়ের উন্নয়নে ভারত থেকে আমদানি করা ইঞ্জিন আর ট্যাংক ওয়াগন উদ্বোধন করেছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। গতকাল দিনের শুরুতে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট  রেলস্টেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সঙ্গে নিয়ে ভারতের প্রেসিডেন্ট তা উদ্বোধন করেন। এ সময় তারা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সবুজ পতাকা নাড়ার পর ২০টি ট্যাংক ওয়াগন ও একটি ব্রেকভ্যান সংযুক্ত ব্রডগেজ ইঞ্জিন চালু হয়। স্টেশনে উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে রেলওয়ের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আবু তাহের ইঞ্জিন ও ওয়াগনগুলো আমদানির বিষয়ে অবহিত করেন। তিনি জানান, ভারতের সঙ্গে ১০০  কোটি ডলারের ঋণচুক্তির আওতায়  রেলওয়েতে ৭৩ কোটি ডলারের ১৪টি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে যার মধ্যে ৬৩ কোটি ডলারের ১১টি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে গেছে। বাংলাদেশ  রেলওয়ে ভারতের কাছ থেকে ২৬টি ব্রডগেজ ইঞ্জিন, ১৫৬টি ব্রডগেজ ট্যাংক ওয়াগন ও ৬টি ব্রেকভ্যান কিনছে। তিনি জানান, আগামী এপ্রিল  থেকে ইঞ্জিনগুলো আসা শুরু হবে। তবে ভারতের প্রেসিডেন্টের সফর উপলক্ষে নির্ধারিত সময়ের আগেই গত বুধবার ২টি লোকোমোটিভ আসে। বর্ণাঢ্য এ উদ্বোধনীতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর, রেলমন্ত্রী  মো. মুজিবুল হক, ডাক ও  টেলিযোগাযোগমন্ত্রী সাহারা খাতুনসহ  রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।