Friday, August 27, 2010

চার লাখ গরু, দেখভালে ১০ জন

পথের দুধারের যেকোনো বাড়িতে তাকালেই চোখে পড়বে গরু ও গোয়ালঘর। সড়কে গরু, মাঠে চরছে গরু। গরুকে পরম যত্নে খাওয়ানো বা স্নান করানোর দৃশ্যও শাহজাদপুর উপজেলার যেকোনো গ্রামের অতি সাধারণ ছবি।
৩২৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের শাহজাদপুরে সরকারি হিসাবে গরুর সংখ্যা তিন লাখ ৭১ হাজার ৮৫টি। এর ৯০ শতাংশই আবার গাভি। তাই পশুর রোগ অ্যানথ্রাক্স (তড়কা) নিয়ে এই এলাকার মানুষই সবচেয়ে বেশি ভাবনায় আছে। সংসারের ভরসা আদরের গরুর অসুখ হলে শাহজাদপুরের মানুষও যেন অসুস্থ হয়ে যায়।
খামারিদের দেওয়া তথ্যমতে, দুগ্ধ উত্পাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেডের (মিল্ক ভিটা) মোট তরল দুধের শতকরা ৮৫ ভাগই যায় এখান থেকে। এ ছাড়া ব্র্যাক, আফতাব, আকিজ, অ্যামো, প্রাণ, বিক্রমপুর ডেইরিসহ আরও অনেক বেসরকারি সংস্থা এ এলাকা থেকে দুধ নেয়। গরুই হচ্ছে এ উপজেলার মানুষের জীবিকার প্রধান মাধ্যম। কিন্তু স্থানীয় মানুষের অভিযোগ, শাহজাদপুরের প্রতি সরকারের প্রাণিসম্পদ কর্তৃপক্ষের বাড়তি কোনো যত্ন নেই। প্রাপ্ত তথ্য তাদের বক্তব্যকেই সমর্থন করে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, গরু অসুস্থ হলে প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের লোকজনকে পাওয়া যায় না।
গবাদিপশুর ব্যবস্থাপনার অবস্থা যে বিশেষ ভালো নয়, তার স্বীকারোক্তি পাওয়া গেল উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আলতাফ হোসেনের কথাতেই। হতাশার সঙ্গে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দেশের অন্য সব উপজেলায় গড়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার গরু আছে। কিন্তু এই উপজেলায় গরুর সংখ্যা পৌনে চার লাখ। অন্য উপজেলার মতোই এখানে মোট জনবল মাত্র ১০। এত কম লোক দিয়ে এখানে সেবা দেওয়া কঠিন।
আলতাফ হোসেন বলেন, ‘এখানে একজনমাত্র চিকিত্সক। তিনি কীভাবে পৌনে চার লাখ গরুর চিকিত্সার দায়িত্ব নেবেন?’
অন্যান্য উপজেলা, মিল্ক ভিটা, মানবমুক্তিসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে লোক এনে আপাতত ভ্যাকসিন কার্যক্রম চালানো হচ্ছে জানিয়ে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘এভাবে ধার করে তো চলা যায় না।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হাবিবুর রহমানও একই কথা বললেন। তিনি বলেন, অন্তত ১০ জন চিকিত্সক এবং ৪২ জন মাঠকর্মী দরকার। ইউএনও জানান, যখনই (ঊর্ধ্বতন) কেউ এ এলাকা পরিদর্শনে এসেছেন, তাঁকে মৌখিকভাবে এ কথা জানানো হয়েছে। এবার ঊর্ধ্বতন মহলকে তিনি চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানাবেন।
শাহজাদপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হাসিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নানা রকম অসুখ-বিসুখের কারণে অনেকেই খামারের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। সরকারের এ ব্যাপারে বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়া দরকার।
শাহজাদপুরের পোতাজিয়া ইউনিয়নের টিআর বন্দর এলাকার খামারি রফিকুল ইসলামও মনে করেন, জনবল বৃদ্ধি ও বিশেষ পরিকল্পনা দরকার। প্রথম আলোকে তিনি বললেন, এই এলাকায় লোকজন যেহেতু গরুর ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে, তাই এখানে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়া উচিত।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দেশের সবচেয়ে বেশি গবাদিপশু সিরাজগঞ্জ জেলায়। এখানে জনবল বাড়ানোটা বিশেষ জরুরি। ১৯৮২ সালের জনবলকাঠামো দিয়েই এখনো অধিদপ্তর চলছে। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে এ বিষয়ে অনেক চিঠি দেওয়া হয়েছে।
সমন্বয়হীনতা, পরস্পরকে দোষারোপ: উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার অভিযোগ, শাহজাদপুরের বেশির ভাগ দুধ নেয় মিল্ক ভিটা। এ ছাড়া অনেক বেসরকারি সংস্থা এখানে কাজ করে। কিন্তু গরুর কোনো অসুখ-বিসুখ হলে দেখভাল করতে হয় প্রাণিসম্পদ কার্যালয়কেই। অথচ মিল্ক ভিটা খামারিদের কাছ থেকে চিকিত্সা বাবদ টাকা কেটে নেয়।
অনেক খামারিও একই অভিযোগ করলেন। রেশমবাড়ী গ্রামের খামারমালিক আবদুস সামাদ ফকির বলেন, মিল্ক ভিটা ও প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। কেউই ঠিকমতো কাজ করে না।
চিথুলিয়া গ্রামের খামারমালিক নুরুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, টাকা ছাড়া প্রাণিসম্পদ বিভাগের লোকজন ভ্যাকসিন (প্রতিষেধক) দেন না। চর চিথুলিয়া গ্রামের কোমেলা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের বাড়ির পাঁচটি গরু মারা গেছে। তাঁর ছেলে আবদুল হামিদ অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত। কোমেলা অভিযোগ করেন, তাঁদের বাড়িতে টিকা দিতে এত দিন কেউ আসেননি। তবে পাঁচটি গরু মারা যাওয়ার পর মিল্ক ভিটার লোকজন টিকা দিয়ে গেছেন।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আলতাফ হোসেন বলেন, এখানকার বেশির ভাগ খামারিই মিল্ক ভিটায় দুধ দেন। কাজেই টিকা দেওয়ার দায়িত্ব তাঁদের।
আলতাফ হোসেন মিল্ক ভিটার বিরুদ্ধে তাঁদের সঙ্গে সমন্বয় না করার অভিযোগ করে বলেন, ‘তারা কোন এলাকায় টিকা দিচ্ছে, আমরা জানি না। তারা হয়তো কোনো এলাকায় ১০০ গরুর মধ্যে তাদের সমিতির ৮০টি গরুকে টিকা দেয়, ২০টি বাকি রেখে আসে। আমরা ওই এলাকায় গিয়ে শুনি, সেখানে টিকা দেওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু ২০টি গরু ঝুঁকিতেই থেকে যায়। কাজেই আমাদের সমন্বিতভাবে কাজ করা উচিত।’
আলতাফ হোসেন আরও বলেন, বিভিন্ন এনজিও গ্রামে নতুন গরু নিয়ে আসে, যা তাঁদের জানানো হয় না। সেগুলোও টিকার বাইরে থেকে যায়।
কিন্তু মিল্ক ভিটার ব্যবস্থাপক (সমিতি) আ ফ ম ইদ্রিস এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি উল্টো প্রাণিসম্পদ বিভাগকে দায়ী করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সর্বশেষ হিসাবে মিল্ক ভিটার সমিতিগুলোর আওতায় শাহজাদপুরে ৭৮ হাজার গরু আছে। এগুলো দেখভালের জন্য আমাদের আটজন সার্জন ও ৬০ জন মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা আছেন। আমরা গত অর্থবছরে ৫১ হাজার তড়কার টিকা দিয়েছি। এর মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগই দেওয়া হয়েছে শাহজাদপুরে। কিন্তু তাঁরা সারা জেলায়ও তো এত টিকা দেননি।’
সমন্বয়হীনতার অভিযোগ সম্পর্কে ইদ্রিস বলেন, ‘আমরা কখন কোন এলাকায় টিকা দিই, সেই অনুলিপি প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়।’
গরুর চিকিত্সার জন্য মিল্ক ভিটা কর্তৃপক্ষের কমিশন কেটে রাখার ব্যাপারে ব্যবস্থাপক বলেন, ‘ক্যাটল ডেভেলপমেন্ট ফান্ড বা সিডিএফ (গবাদিপশু উন্নয়ন তহবিলের) হিসেবে আমরা প্রতি লিটার দুধের দাম দেওয়ার সময় ২৫ পয়সা করে কেটে রাখি। এর মধ্যে জাত উন্নয়ন, কৃত্রিম প্রজননসহ সবকিছু আছে। চিকিত্সার জন্য আলাদা করে টাকা কাটা হয় না। আর কোথাও কোনো গরু অসুস্থ হয়েছে শুনলেই আমরা ছুটে যাই।’
অ্যানথ্রাক্স পরিস্থিতি: গবাদিপশুর অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণের মাত্রা কমে এলেও মানুষের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা এখনো বাড়ছে। গতকাল ১৯ জন নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে বেলকুচিতে রয়েছেন ছয়জন, কামারখন্দে পাঁচজন এবং শাহজাদপুরে আটজন। এ নিয়ে সিরাজগঞ্জে মোট ১৪১ জন এই রোগে আক্রান্ত হলেন। আক্রান্ত ব্যক্তিরা সবাই অসুস্থ গরু জবাই বা কাটাকাটি করেছেন কিংবা মাংস খেয়েছেন।
জেলার সিভিল সার্জন নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। পুরোনো আক্রান্তদের ঘা শুকিয়ে আসছে। নতুন করে যাঁরা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁদের রক্ত সংগ্রহ করে ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে। নতুন করে কোনো আক্রান্ত এলাকা না পাওয়া গেলে ঢাকা থেকে আসা টিমগুলো ফেরত যাবে।’
শাহজাদপুরের অ্যানথ্রাক্স-পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আলতাফ হোসেন বলেন, গরুর সংখ্যা বেশি বলে এই এলাকায় অ্যানথ্রাক্সের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। আপাতত বাইরে থেকে এনে মোট ৮০ জন লোক নিয়ে আক্রান্ত এলাকা ও এর আশপাশে টিকা দেওয়া কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সব গরুকে টিকা দিতে ১৫ দিন লেগে যাবে। তিনিও পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে বলে দাবি করেন।

No comments: