কৈশোর পেরিয়ে সবে তারুণ্যে পা রেখেছেন। আশপাশের দশ গাঁয়ের লোকে তাঁকে এক নামে চেনে। জিয়া, পুরো নাম জিয়ারুল ইসলাম। কুঁকড়া চুলের, ছোটখাটো গড়নের মানুষ। জারিগানের দল নিয়ে যিনি ঘুরে বেড়ান গ্রাম থেকে গ্রামে। নিজে গান না, কিন্তু তাঁর লেখা গান দিয়ে মানুষকে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করেন। মানুষের মাঝে সামাজিক দায়িত্ববোধ ও সচেতনতা গড়ে তোলেন। বিনিময়ে নিজে কিছু নেন না। গানের দলের পাশাপাশি পড়াশোনাও চালিয়ে যাচ্ছেন জিয়া। এবার এইচএসসি পাস করেছেন।
জিয়ারুল ইসলামের (১৯) বাড়ি রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার ভুটকা গ্রামে। বাবা কৃষক। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। কিশোর বয়সেই পারিবারিক ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে নানা অসংগতি ভাবিয়ে তোলে জিয়াকে। চারপাশের পরিবেশকে সুন্দর রাখতে হলে কী করতে হবে, বাল্যবিবাহ ও যৌতুকপ্রথা রোধে কী কী করণীয়, তার সবই পাঠ্যবইয়ে লেখা আছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। কেউ সেসব মানে না। তখন থেকেই মনে মনে নিজের গ্রামকে বদলে ফেলার পণ করেন। সেই আজ থেকে বছর পাঁচেক আগের কথা।
ভাবতে শুরু করেন জিয়া—কীভাবে মানুষকে বদলের পথে আনা যায়। একসময় একটা পথও বেরিয়ে গেল। বিনোদনই সহজ উপায়, যার মাধ্যমে গাঁয়ের সহজ-সরল মানুষগুলোর কাছে পৌঁছানো যাবে। কিন্তু টাকা পাবেন কোথায়! বাবার কাছে হাত পেতে তেমন সাড়া মিলল না। গেলেন বড় ভাই আলমগীর ইসলামের কাছে। ভাই তাঁকে আশ্বস্ত করলেন। শুরুতে কয়েকজনকে নিয়ে একটি জারিগানের দল গঠন করলেন। গানের দলের জন্য বড় ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে হারমোনিয়াম, ঢোল, একতারা, মন্দিরা কিনলেন। নিজেই লিখলেন সামাজিক সচেতনতামূলক গান। জারিগানের দলটি প্রথমে ভুটকা গ্রামের কয়েকটি বাড়িতে গান করল। পরে গেল পাশের গ্রামে। এভাবে একে একে গঙ্গাচড়ার ৬৭টি গ্রামে দল নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন জিয়া।
স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা না থাকলে, কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিলে কী কী ক্ষতি হয়—সেসব নিয়ে নাটিকা বানালেন জিয়া। যৌতুকপ্রথার বিরুদ্ধেও রচনা করলেন নাটিকা। মানুষের বাড়ির উঠোনে পরিবেশন করলেন। জিয়ার এসব সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডে সর্বশেষ সংযোজন—ইভ টিজিং। গত বছর বড় ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে একটি প্রজেক্টর কিনেছেন। রাতের বেলা প্রজেক্টরে গ্রামবাসীকে তথ্যচিত্রও দেখাচ্ছেন জিয়া।
জিয়ার কর্মকাণ্ড দেখে উপজেলার বুড়িরহাট এলাকার কারমাইকেল কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী মেরিনা বেগম বললেন, ‘জিয়ার মতো সবাই যদি এভাবে সামান্য কিছু কাজ করত তাহলে গ্রামগুলো সুন্দর হয়ে উঠত।’ একই এলাকার সরকারি বেগম রোকেয়া মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী বিউটি খাতুন বলেন, সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর অনেক টাকা খরচ করছে। কিন্তু গ্রামের এক তরুণ নিজ উদ্যোগে যে কাজটি করছেন, তাতে গ্রামের দৃশ্যপট পাল্টে যেতে শুরু করেছে।
ভুটকা গ্রামের লাল মিয়া বলেন, ‘হামার জিয়ারুল শিখাইল কেমন করি ভালো পরিবেশে বাস করা যায়।’ কিষানি কবিতা রানী বলেন, ‘হামরা আগোত ঝোপঝাড়ে প্রাকৃতিক কাজ সারছি। কিন্তু জিয়া তাঁর গানের দল নিয়া গান গায়া বিনোদন দিয়া মানুষগুলাক সচেতন করার চেষ্টা করছেন।’
জিয়ারুল ইসলাম এ বছর গঙ্গাচড়া ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন। মানবিক বিভাগে তিনি জিপিএ-৪ দশমিক ১০ পেয়েছেন। ২০০৫ সালে যখন তিনি গঙ্গাচড়া মডেল হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র, তখনই দলবল নিয়ে নেমে পড়েছিলেন। তিনি গান লিখে দেন। দলের লোকজন সেসব গেয়ে শোনায়। সে জন্য কারও কাছ থেকে টাকা-পয়সা নেন না। উল্টো বাড়িতে কয়েকজন ছেলেমেয়েকে পড়িয়ে যে টাকা পান, সেটা দলের লোকদের পেছনে খরচ করেন।
জিয়ার গানের দলের সদস্য সাতজন। তাঁরা হলেন আনোয়ার হোসেন, গোলাম মোস্তফা, প্রফুল্ল চন্দ্র, জগদীশ চন্দ্র, অনন্ত চন্দ্র, রবীন চন্দ্র ও রত্না পারভিন। তাঁরা জানান, জিয়ারুলের সঙ্গে এই কাজ করে তাঁরা আনন্দ পান। তাই বিনিময়ে কিছু চান না। বড় কথা হলো, এভাবে মানুষকে কিছুটা হলেও জাগিয়ে তোলা যাচ্ছে।
জিয়ারুল বলেন, ‘সামান্য অভ্যাস পরিবর্তন করলেই মানুষ বদলাতে পারে। বদলে যেতে পারে গ্রামের দৃশ্যপট। এতে খুব একটা টাকার প্রয়োজন পড়ে না।’ এসব কাজ করে আপনার লাভ কী—জানতে চাইলে বলেন, ‘সব সময় নিজের লাভ দেখলে কি ভালো কাজ করা সম্ভব! সমাজ উপকৃত হলে এর চেয়ে বড় লাভ কী হতে পারে।’ গঙ্গাচড়া সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘কিশোর বয়স থেকে জিয়া এখনো যে কাজটি করে চলেছেন, এর কোনো তুলনা হয় না।’
উপজেলা চেয়ারম্যান মজিবর রহমান প্রামাণিক বলেন, ‘শুনেছি, কিশোর বয়স থেকে এমন কাজ করে আসছে ছেলেটা। গানের দল নিয়ে হাটে-মাঠে ঘুরে বেড়ায়। আবার পড়াশোনাও করে।’
No comments:
Post a Comment