Sunday, April 24, 2011

রাজশাহী মেডিক্যালের দুই ছাত্রের হাতে বন্ধু খুন

মাহবুব আলম রাসেল, জ্যোতির্ময় জয় ও সাবি্বর হোসেন। তাঁরা একে অপরের বন্ধু। বন্ধুত্বের এই বন্ধন যে এভাবে ছিন্ন হবে তা ভাবতেও পারেননি রাসেলের বাবা মকবুল হোসেন। কিন্তু তা-ই সত্যি হলো। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের দুই ছাত্রবন্ধু জয় ও সাবি্বরের হাতেই খুন হলেন রাজশাহী কলেজের ছাত্র ও ব্যবসায়ী রাসেল (২৪)। পাওনা টাকা পরিশোধে চাপ দেওয়ায় রাসেলকে খুন করা হয় বলে জানা গেছে।
হত্যাকাণ্ডের ১৭ দিন পর গতকাল শুক্রবার দুপুরে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের ক্যান্টিনের পিছনের একটি ড্রেন থেকে রাসেলের গলিত লাশ উদ্ধার করে র‌্যাব। রাসেলের পরিবারের করা মামলায় এর আগে গতকাল ভোররাতে জয়কে গ্রেপ্তার করা হয়। জয়ের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতেই র‌্যাব সদস্যরা রাসেলের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠান। রাসেলের আরেক বন্ধু সাবি্বর পলাতক।
রাসেলদের বাড়ি নাটোরের লালপুর উপজেলায়। জয় নাটোরের বাগাতিপাড়া গ্রামের জগদিশ চন্দ্র সরকারের ছেলে। তিনি রাজশাহী মেডিক্যাল
কলেজের পঞ্চম বর্ষের (৪৭তম ব্যাচ) ছাত্র। তাঁর সহপাঠী সাবি্বর গাজীপুর জেলার মৃত শাহাদত হোসেনের ছেলে। তাঁদের পরিবার বর্তমানে ঢাকার রামপুরা এলাকায় থাকে।
জয়ের দেওয়া তথ্য উদ্ধৃত করে র‌্যাব জানায়, রাসেল আইপিএলের বাজি জিতে সাবি্বরের কাছে তিন লাখ টাকা পেতেন। তা ছাড়া ১৫ শতাংশ সুদে ধার নেওয়া দেড় লাখ টাকা পেতেন জয়ের কাছে। ওই টাকা পরিশোধে চাপ দেওয়ায় জয় ও সাবি্বর গত ৪ এপ্রিল রাসেলকে নাটোরের আবদুলপুর বাজারে তাঁর ইলেকট্রনিকসের দোকান থেকে ডেকে নিয়ে আসেন। এরপর ওই দিনই রাত ১২টার দিকে তাঁরা রাসেলকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চারু মামার ক্যান্টিনের সামনে নিয়ে যান। সেখানে ক্যান্টিনের সামনে বসে তাঁরা তিনজন তিনটি ফেনসিডিল পান করেন। রাসেলকে তাঁরা ফেনসিডিলের যে বোতলটি পান করতে দিয়েছিলেন তাতে ঘুমের ওষুধ মেশানো ছিল। এ কারণে রাসেল ফেনসিডিল পানের কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েন। এরপর রাসেলকে হত্যা করার জন্য তাঁর শরীরে সাবি্বর বিষজাতীয় ইনজেকশন পুশ করেন। ১০ মিনিট পরে রাসেল মারা যান। এরপর জয় ও সাবি্বর দুজনে মিলে রাসেলের লাশ চারু মামার ক্যান্টিনের পিছনে নিয়ে ড্রেনের স্লাব ও মাটি তুলে সেখানে ফেলে দেন। দ্রুত পচে যাওয়ার জন্য লাশের ওপর প্রথমে সিমেন্ট ও কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এরপর মাটি দিয়ে চাপা দিয়ে কচুগাছ লাগানো হয়।
জয় র‌্যাবকে জানান, তিনি মানুষের কংকালের ব্যবসা করতেন। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ থেকে কংকাল কিনে নিয়ে অন্য জায়গায় বিক্রি করতেন। এই ব্যবসার জন্য তিনি রাসেলের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিলেন। রাসেলকে হত্যা করার জন্য সাবি্বর ও জয় এক সপ্তাহ আগেই পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন।
রাসেলের বাবা মকবুল হোসেন জানান, জয় হিন্দু সমপ্রদায়ের ছেলে হলেও প্রায় সাত বছর আগে নাটোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজে একাদশ শ্রেণীতে একসঙ্গে পড়ার সময় রাসেলের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এরপর এইচএসসি পাস করে রাসেল রাজশাহী কলেজে অর্থনীতিতে এবং জয় রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়। সেই সুবাদে মাঝে-মধ্যেই জয় তাঁদের বাসায় যাতায়াত করত। একপর্যায়ে জয়ের বন্ধু সাবি্বরের সঙ্গেও বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে রাসেলের। মকবুল হোসেন জানান, জয় ও সাবি্বর ঠিকাদারি ব্যবসা এবং কোচিং সেন্টার খোলার নাম করে প্রায় ১০ লাখ টাকা রাসেলের কাছ থেকে ধার নিয়েছিল। এই টাকা পরিশোধের জন্য রাসেল মাঝে-মধ্যেই তাদেরকে বলত।
মকবুল হোসেন আরো জানান, গত ৪ এপ্রিল দোকানের মালামাল কেনার নাম করে রাসেল তার বন্ধু জয় ও সাবি্বরের সঙ্গে নাটোরের আবদুলপুর রেলস্টেশন থেকে বিকেল ৫টার সময় পদ্মা ট্রেনে চড়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয়। ওই দিন সন্ধ্যা ৭টায় ছেলের সঙ্গে কথা হয় মকবুলের। রাত ১০টার দিকে রাসেলের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরদিনও রাসেলের ফোন বন্ধ পাওয়ায় তিনি সাবি্বরকে ফোন করেন। তখন সাবি্বর তাঁকে জানিয়েছিলেন, রাসেল ভালো আছে, কোনো সমস্যা হয়নি। চার্জ না থাকায় তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ হয়ে আছে। সে খুব ব্যস্ত থাকায় কথা বলতে পারছে না বলেও জয় মকবুল হোসেনকে জানিয়েছিলেন। এরপর মকবুল হোসেনের সঙ্গে জয় ও সাবি্বর এভাবে আরো কয়েকবার প্রতারণা করতে থাকেন। সর্বশেষ জয়ের সঙ্গে গত ৭ এপ্রিল কথা হয় মকবুল হোসেনের।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে মকবুল হোসেন বলেন, 'রাসেলকে এভাবে কৌশলে অপহরণ করে হত্যা করা হবে, এটা কখনো চিন্তাই করতে পারিনি। আমি ছেলে হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই।' ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে রাসেলের মা রেহেনা খাতুন শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন।
রাসেলের ভগি্নপতি মাজেদুর রহমান জানান, রাসেলের ফোন বন্ধ থাকার পর যখন জয় ও সাবি্বরের মোবাইলও বন্ধ হয়ে যায়, তখন তাঁদের সন্দেহ হয়। এরপর রাসেলের পরিবারের লোকজন ধারণা করেন, তাঁকে জয় ও সাবি্বর অপহরণ করেছে। কোনোমতেই তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারায় গত ১৫ এপ্রিল রাসেলের বাবা লালপুর থানায় জয় ও সাবি্বরের নামে একটি অপহরণ মামলা করেন।
রাজশাহী র‌্যাব-৫-এর ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর রাকিবুল হাসান সাংবাদিকদের জানান, জয় ও সাবি্বর দুজনই রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে পড়ে বলে মামলাটি হাতে পাওয়ার পর লালপুর থানা থেকে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এরপর মোবাইল ট্র্যাকারের মাধ্যমে জয়কে গতকাল ভোর ৩টার দিকে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। গতকাল রাতে তাঁকে লালপুর থানায় হস্তান্তর করা হয়। পলাতক সাবি্বরকেও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে তিনি জানান।
জয়ের দেওয়া তথ্য উল্লেখ করে র‌্যাব জানায়, রাসেলকে হত্যার পর গত ৯ এপ্রিল সাবি্বর ও ১০ এপ্রিল জয় রাজশাহী ছেড়ে পালিয়ে যান। মেজর রাকিবুল বলেন, 'জয়ের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী আমরা অনেকটাই নিশ্চিত হয়েছি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জয় ও সাবি্বরই জড়িত ছিলেন। আর কেউ জড়িত আছে বলে আমাদের কাছে মনে হচ্ছে না।'
গতকাল সন্ধ্যায় ময়নাতদন্ত শেষে রাসেলের লাশ তাঁর গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। তাঁর লাশ একঝলক দেখার জন্য এলাকার শত শত নারী-পুরুষ ভিড় জমায়। রাতেই পারিবারিক কবরস্থানে রাসেলের দাফন সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে।
যেভাবে উদ্ধার হলো লাশ : জয়কে নিয়ে র‌্যাবের একটি দল গতকাল দুপুর ২টার দিকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের চারু মামার ক্যান্টিন এলাকায় আসে। এরপর যেখানে রাসেলকে পুঁতে রাখা হয়েছিল সেখানে র‌্যাব ও সাংবাদিকদের নিয়ে যান জয়। কলেজের মূল ভবন থেকে ১০ হাত দূরে উত্তর পাশে চারু মামার ক্যান্টিন। ক্যান্টিনের পেছনে মাটি আর পানিতে ভরে যাওয়া একটি ড্রেন। সব সময় পানি জমে থাকে বলে এখানে কিছু কচুগাছও জন্ম নিয়েছে। এই কচুগাছের মধ্যে সামান্য একটু আলগা করা মাটি। তার ওপর চাপানো রয়েছে ছোট ভাঙা একটি স্লাব। জয় নিজে স্লাবটি টেনে তুলতেই লাশের পচা গন্ধ বের হতে থাকে। পরে ডোম ডেকে রাসেলের লাশ তোলা হয়।
রাসেলের পরিচিতি : নাটোরের লালপুর উপজেলার মকবুল হোসেনের এক ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে রাসেল ছিলেন ছোট। ২০০৩ সালে নাটোরের করিমপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে রাসেল নাটোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজে ভর্তি হন। এরপর সেখান থেকে ২০০৫ সালে এইচএসসি পাস করে অনার্স পড়ার জন্য রাজশাহী কলেজে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। ছাত্র থাকা অবস্থায়ই ২০০৮ সালের ১৬ এপ্রিল তিনি বিয়ে করেন। বিয়ের পর রাসেল এলাকায় ইলেকট্রনিকসের দোকান দেন। তাঁর আড়াই বছরের একটি ছেলে সন্তান আছে।

No comments: