রাজশাহীর ঝরনা বেগম ও একজন আহত রক্তাক্ত পুলিশের গল্পটা এখন সবারই জানা।
ঘটনাটা কেন আমাদের টানে? কেন আমরা এ ধরনের ঘটনা জেনে আবেগতাড়িত হয়ে পড়ি?
বারবার ফিরে তাকাই রাজশাহীর সেই ছবিটির দিকে? পুলিশকে তো আর জনগণের বন্ধু
মনে হচ্ছিল না আমাদের। পুরুষপ্রধান পুলিশ বাহিনীকে খুব কমই নারীবান্ধব হতে
দেখা গেছে। মানুষের বিপদে যদি পুলিশ না আসে, তাহলে পুলিশের বিপদে মানুষ কেন
যাবে? শিবির বনাম পুলিশের মারামারিতে সাধারণ মানুষের যেখানে দূরে দাঁড়িয়ে
দেখার কথা, সেখানে ঝরনা বেগমের মতো একজন বিউটি পারলারের কর্মীর ঝুঁকি নিয়ে
পুলিশ বাঁচানোর দরকার কী ছিল?
এত সব প্রশ্ন আর সিদ্ধান্তকে গলিয়ে দিল রক্তাক্ত পুলিশের জীবন বাঁচাতে
জীবনের ঝুঁকি নেওয়া ঝরনা বেগমের মানবিক ‘অ্যাকশন’। তাঁর এই অ্যাকশনের ভাষা
যদি ঠিকঠাক বুঝে থাকি, তাহলে দেখতে পাব: ১. বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতার
সময়ে পুলিশের বিপদকে পুলিশের একার বিপদ মনে করছেন না অনেক মানুষ। তাঁরা
হয়তো ভাবছেন, পুলিশ পরাজিত হলে জনগণের নিরাপত্তা দেওয়ার আর কেউ থাকবে না।
পুলিশ অতীতে জনগণের বন্ধু যদি না-ও হয়ে থাকে, বর্তমানে তারাই জনগণের
নিরাপত্তার জন্য লড়াই করে প্রাণ দিচ্ছে, আহত হচ্ছে। সুতরাং, তাদের পাশে
দাঁড়াতে হবে। ২. অনেক পুরুষ পুলিশ নারীদের প্রতি অসদাচরণ করে এলেও অনেক
নারীই পুরুষ পুলিশের প্রতি দয়াবান ও ক্ষমাশীল হতে পারেন। ৩. দুর্বৃত্ত
রাজনীতির খেলায় জনগণ নীরব দর্শক নন, জনগণের লোকও দায়িত্ব নিতে জানেন।
ঝরনা বেগম তাই একটি ঘটনা। যেমন ঘটনা ছিলেন রংপুরে উত্ত্যক্তকারীদের কবল
থেকে তরুণীকে বাঁচাতে গিয়ে খুন হওয়া শিক্ষক। যেমন ঘটনা ছিলেন ঢাকার
মিরপুরের হজরত আলী, যিনি ছিনতাইকারীদের হাত থেকে একজন নারীকে বাঁচাতে জীবন
দিয়েছিলেন। এই ‘ঘটনা’গুলো জনগণের নিজস্ব অস্তিত্বের, নিজস্ব সক্রিয়তার
প্রমাণ। এ কারণে বলছি যে নিজেকে বিপন্ন করে মানুষের ভালো করার নজির
উচ্চমহলে কম, নিচের মহলে বিস্তর। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এই সুনীতি জনগণের
কীর্তি, আর মানুষের বিপক্ষে দাঁড়ানোর দুর্নীতি ও দুর্বৃত্ত নীতিই শাসকদের
কীর্তি। দুই পক্ষের স্বভাবও তাই আলাদা। তাই আজকে ক্ষমতাবান কোনো
নেতা-নেত্রী-কর্তাব্যক্তি যখন বলেন, ‘আমি জনগণের লোক;’ তখন সঠিক বলেন না।
যাঁরা সত্যিকার জনগণের লোক, তাঁরা দাবি করেন না কিছুই, কেবল কাজটা করে
ফেলেন। তাই দেখি, সাধারণ মানুষ বলে যাঁদের জনসংখ্যার একেকটি সংখ্যা করে
রাখা হয়, তাঁরাই বারবার পরিসংখ্যানের কারাগার ভেঙে একেকজন হূদয়বান মানুষের
চেহারায় দাঁড়িয়ে পড়েন। তাঁদের আচরণকে তখন আমরা আদর্শ মানুষের আচরণ বলে
চিনতে পারি। তখনই আমাদের বিশ্বাস হয় যে মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ। এই
দুর্দিনে এই বিশ্বাস যাঁরা বাঁচিয়ে রাখেন, তাঁরা সাধারণের অসাধারণ বীর।
রাজশাহীতে সেদিন সারা দেশের মতোই হরতাল চলছিল। বাড়ির মধ্যেই কাজ করছিলেন
ঝরনা। হঠাৎ বাইরে বিকট শব্দ শুনে ঘরের বাইর হলেন। দুটি ছোট ছেলে তাঁর, তারা
বাইরে খেলছিল। তাই মায়ের মন নিয়ে তিনি বেরিয়ে এসে মায়ের মন নিয়েই দেখতে
পেলেন নৃশংস ঘটনাটি। রাস্তায় ফেলে ইট দিয়ে পিটিয়ে থেঁতলে দেওয়া হচ্ছে এক
পুলিশকে। রক্তে ভিজে যাচ্ছে তাঁর মাথা। আশপাশে মানুষ ছিল, কিন্তু সহায় ছিল
না কেউ। ঝরনা বেগম পুলিশ দেখলেন না, দেখলেন মানুষ মরছে। তিনি দৌড়ে এসে পড়ে
থাকা লোকটিকে তুলতে গেলেন। তাঁর ডাকাডাকিতে দুজন ‘সাংবাদিক’ও মানুষের মতো
‘মানুষ’ হয়ে গেলেন। ছবি তোলা ফেলে ঝরনার মতোই রক্তাক্ত মানুষটিকে তুলে
প্রমাণ করলেন মানুষ মানুষের জন্য। মানুষের রক্ত দেখে খুনি-সন্ত্রাসী বিচলিত
না হলেও মানুষ বিচলিত হবেই। ঝরনা বেগম সে ধরনের মানুষের প্রতীক হয়ে গেলেন।
কোনো কোনো অন্যায় একজন করলেও সবাই কমবেশি অপরাধী হয়ে যায়। কোনো কোনো ভালো
কাজ একজন করলেও সবাই দায়মুক্ত হন। পুলিশ সদস্যটি যদি সাহায্যের অভাবে সেদিন
মারা যেতেন, তাহলে আমরা সবাই-ই দায়িত্বহীনতার দায়ে দায়ী থাকতাম। ঝরনা বেগম
সেই দায় থেকে আমাদের রক্ষা করলেন। বুঝিয়ে দিলেন এই বাজারি পরিবেশে এই
সন্ত্রাসের রাজত্বে মানুষ হারিয়ে যায়নি। মানুষ এখনো আছে।
জনগণকে অদৃশ্য, নিষ্ক্রিয় ও ভীত করে রাখার দাপট আমরা দেখছি দেশজুড়ে। মাসের
পর মাস জামায়াত ও বিএনপি হরতাল আর নাশকতায় জনগণকে কোণঠাসা করে রেখেছে। আগুন
আর মৃত্যু দিয়ে তারা দেশ বাঁচাতে চায়। সরকারও গুলি দিয়ে গণতন্ত্র বাঁচানো
সম্ভব বলে ভাবছে। এই আগুন আর গুলির রাজনীতি জনগণকে জিম্মি করে ফেলছে। সেই
অবস্থায় গত মাসে কানসাটসহ বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষ সন্ত্রাস-নাশকতার
বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। এখন দেখলাম, ঝরনা বেগমের সাহসিকতা। এভাবে কানসাট,
ফুলবাড়ী, আড়িয়ল বিলে বারবারই লক্ষ লক্ষ মানুষের মানবিক ও সাহসিক ‘অ্যাকশন’
বুঝিয়ে দিয়েছে, ‘আমরা জনগণ, আমরা মরে যাইনি আজও।’
জনগণকে সবাই ভয় পায়, সবাই তাদের খোপে খোপে আটকে রাখতে চায়। ভোটব্যাংকের
খোপ, বাজারের ক্রেতা বানানোর খোপ, দলীয় আনুগত্যের মিছিলের খোপ, টেলিভিশনের
খোপ, বাসযাত্রীর খোপ, শবযাত্রীর খোপ। জনগণের নিজস্ব চাওয়া-পাওয়া,
চলাফেরা—কত কত রকমের খোপে আটক আর নির্বাক। এসব ছাপিয়ে তাই যখন কেউ ‘সাধারণ’
মানুষ নামের ‘ভীরুতা-দুর্বলতা-নিষ্ক্রিয়তার’ তকমা খুলে ফেলে অসাধারণ কোনো
কাজ করে ফেলেন, তখন তাঁকে আমাদের ভালোবাসতেই হয়। তখনই মনে হয়, মানুষে
বিশ্বাস হারানো আসলেই পাপ, মানুষে ভরসা রাখতেই হবে আমাদের।
ঝরনা বেগমদের সুবাদে তাই বলতে চাই, যাঁরা সবকিছুর জন্য জনগণকে দোষারোপ
করেন, বলেন মানুষই আসলে খারাপ, বলেন মানুষ অসচেতন, মানুষ নিষ্ক্রিয়, তাঁরা
ভুল বলেন। যাঁরা জনসাধারণ, যাঁরা সব অর্থেই নিচুতলার বাসিন্দা, যাঁরা
মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত, যাঁরা অধিকাংশ নারী, যাঁরা কৃষকসমগ্র, যাঁরা
সাধারণ স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষার্থী, যাঁরা গ্রাম-শহরের পেশাজীবী,
তাঁরাই জনগণ। সব সংকটে তাঁরাই উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করেন। সুযোগ পেলে তাঁরা
তাঁদের সবচেয়ে ভালোটাই দেশ ও মানুষকে দিতে আসেন। সমাজতত্ত্বের আর রাজনীতির
ছাই দিয়ে এঁদের জীবনবাদিতা আর কষ্ট সহ্যের ক্ষমতার পরিমাপ করা যাবে না।
তাঁরা আছেন বলেই এখনো দেশটা আছে। তাই এ কথা ঠিক নয়, যে জাতি যেমন সেই জাতি
তেমন নেতৃত্বই পায়।
বরং আমাদের দুঃখটা এখানেই, আমাদের মানুষগুলো যতটা নিষ্ঠাবান ও সাহসী,
আমাদের সব রকমের কর্তাব্যক্তিরা ততটা নন। আমরা আমাদের উপযুক্ত কান্ডারি
পাইনি। পেলে ঝরনা বেগমদের এভাবে রাস্তায় পুলিশকে বাঁচাতে নামতে হতো না।
পুলিশ নিজেই নিজের ও জনতার রক্ষক হতে পারত। পুলিশ যেন কথাটা মনে রাখে,
রাজনীতিবিদেরা যেন কথাটা মনে রাখেন, দেশের কর্তাব্যক্তিরা যেন কথাটা মনে
রাখেন।