ট্রেনটি আসছিল নারায়ণগঞ্জ থেকে। কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছাতে আর অল্প সময় বাকি। তখনই ঘটে গেল মর্মান্তিক ঘটনাটি। কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে সায়েদাবাদ রেলক্রসিংয়ে দুটি বাসকে ধাক্কা দেয় ট্রেনটি। বাস দুটি গিয়ে পড়ে পাশের ফল ও হালিম বিক্রেতার দোকান আর রিকশার ওপর। ঘটনাস্থলেই মারা যান চারজন। পরে হাসপাতালে আরও দুজনের মৃত্যু হয়। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে দুজন নারী। আহত ১৩ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
গতকাল বুধবার বিকেল পাঁচটার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে। বাসগুলো টিকাটুলি থেকে যাত্রাবাড়ীর দিকে যাচ্ছিল। এর একটি ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ ও অন্যটি মিরপুর থেকে যাত্রাবাড়ী রুটে চলাচল করে। দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের মধ্যে বাসযাত্রী ছাড়াও পথচারী ও ঘটনাস্থলে অবস্থানকারী ব্যক্তি রয়েছেন।
দুর্ঘটনার পর টিকাটুলি থেকে সায়েদাবাদের দিকে যাওয়া-আসার সড়ক বন্ধ থাকে প্রায় দেড় ঘণ্টা। ট্রেনের চালক ট্রেন ফেলে পালিয়ে যাওয়ার পর রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বিকল্প চালকের মাধ্যমে ট্রেনটি সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার সময় সরিয়ে নেয়। এরপর যান চলাচল শুরু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এ ঘটনার জন্য সায়েদাবাদ রেলক্রসিংয়ের লাইনম্যানকে দায়ী করেছেন। লাইনম্যান সময়মতো টিকাটুলির পাশের প্রতিবন্ধক দণ্ড না নামানোয় দুটি বাস রেললাইনের ওপরে উঠে যায়। এ সময় লাইনম্যান সায়েদাবাদের দিকের প্রতিবন্ধক দণ্ডটি ফেলে দেওয়ায় বাসগুলো আর এগোতে পারেনি। এ সময়েই ট্রেনটি হুইসেল বাজাতে বাজাতে আসতে থাকে। কিন্তু বাসগুলোর তখন না ছিল এগোবার উপায়, না পেছানোর উপায়। কারণ পেছনে তখন গাড়ি আর রিকশার লম্বা সারি। ফলে দুর্ঘটনা ছিল অবধারিত।
ট্রেনটি নারায়ণগঞ্জগামী বেকার পরিবহন (নারায়ণগঞ্জ-ব ১১০০৩৯) ও মিরপর থেকে যাত্রাবাড়ীগামী বিকল্প পরিবহনের (ঢাকা মেট্রো-জ ১১৩১১৬) গাড়িটিকে সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে বেকার পরিবহনের বাসের এক পাশ দুমড়েমুচড়ে যায়। বিকল্প পরিবহনের বাসটির ক্ষতি ছিল অপেক্ষাকৃত কম। ট্রেনের ধাক্কায় বাস দুটি রেললাইনের পাশের কয়েকটি ফলের দোকান, একটি হালিমের দোকান, একটি রিকশা ও কয়েকজন পথচারীর ওপর গিয়ে পড়ে।
রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত নিহত তিনজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন পথচারী লিসা বেগম (৩৮)। তিনি যাত্রাবাড়ীর করাতিটোলার বাসিন্দা। সায়েদাবাদে মেয়ের বাসা থেকে ফিরছিলেন তিনি। অপরজন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের ছাত্র নাজিম উদ্দিন। বাড়ি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে। আরেকজন হলেন ফুটপাতের হালিম বিক্রেতা আবেদ আলী (৫৫)। তাঁর গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের জাজিরায়, থাকতেন গেন্ডারিয়ার ঘুণ্টিঘর এলাকায়।
আহত ব্যক্তিরা হলেন আলী আকবর (৩০), জামাল হোসেন (৩৮), তারিকুল ইসলাম, (৩৮), আক্তার হোসেন (৩০), শারমিন (১৮), তাঁর স্বামী সোহেল (২৫), কমল সরকার (৫০), ইমন (২২), ঊর্মি (২৫), আমেনা বেগম (৫০), মামুন (২২), মোস্তফা (৩৫) ও নটর ডেম কলেজের ছাত্র তারেক (২৩)। তাঁরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার তৌফিক মাহবুব চৌধুরী প্রথম আলোকে জানান, হতাহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই বাসযাত্রী। কয়েকজন পথচারী।
দুর্ঘটনার পরপরই ট্রেন ও দুটি বাসের চালক এবং তাঁদের সহকারী, রেলক্রসিংয়ে লাইনম্যান ও ট্রেনের চালক পালিয়ে যান।
ঘটনাটি কীভাবে ঘটল, জানতে চাইলে র্যাব-৩-এর কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল মো. রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, লাইনম্যান সময়মতো বার ফেলেনি। ফলে বাস দুটি রেললাইনের ওপর উঠে পড়ে। আর ট্রেনের ধাক্কায় বাস দুটি আশপাশের দোকান ও রিকশার ওপর গিয়ে পড়ে।
সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডের সামনে দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনাটি দেখছিলেন বাবু নামের এক ব্যক্তি। ঘটনার তিনি এ রকম বর্ণনা দেন, ‘বাসগুলো রেলক্রসিংয়ের ওপর দাঁড়ানো ছিল। কিন্তু সামনের বাঁশ (প্রতিবন্ধক দণ্ড) ফালানো ছিল। এ কারণে ট্রেন হুইসেল বাজালেও বাসগুলো সরতে পারে নাই। ট্রেনটা ধাক্কা দিয়া বাসগুলানরে ফুটপাতের ফলের দোকান আর রিকশার ওপর নিয়া ফেলল।’
দুর্ঘটনার পর টিকাটুলি থেকে সায়েদাবাদ পর্যন্ত সড়কে যান চলাচল দেড় ঘণ্টার জন্য বন্ধ থাকে। ট্রেনের চালক পালিয়ে যাওয়ায় ট্রেনটি সরানোর কেউ ছিল না। ফলে এই রুটের গাড়িগুলো ঘুরে আশপাশের বিভিন্ন সড়ক দিয়ে চলাচল করে। এতে করে গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, কমলাপুর, মতিঝিল এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। পরে সন্ধ্যা ছয়টা ২০ মিনিটের দিকে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বিকল্প চালকের মাধ্যমে ট্রেনটি সরিয়ে নিলে যান চলাচল আবার শুরু হয়।
আহতদের মুখে ঘটনার বর্ণনা: আহত বাসযাত্রী গিয়াস উদ্দিন সরকার বলেন, তিনি বাংলাদেশ জুট করপোরেশনের মতিঝিল অফিসে কাজ করেন। অফিস শেষে নারায়ণগঞ্জের বাসায় যাওয়ার জন্য বেকার পরিবহনের একটি বাসে ওঠেন। ৫২ আসনের এই বাসে কয়েকজন যাত্রী দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাসটি সায়েদাবাদ রেললাইন অতিক্রম করার আগেই যানজটে আটকে যায়। কিছুক্ষণ পর তাঁদের বাসটি সায়েদাবাদ রেলক্রসিং পার হচ্ছিল। বাসটির সামনের অংশ রেলক্রসিং পার হওয়া মাত্র পেছনের যাত্রীরা ট্রেন ট্রেন বলে চিৎকার করে ওঠেন। অনেকে গেট ও জানালা দিয়ে দ্রুত নেমে যান।
গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘জীবন বাঁচাতে আমি হতাহত ব্যক্তিদের ওপর দিয়ে লাফিয়ে পালাচ্ছিলাম।’ তখন পাশেই তাঁর প্রতিবেশী আমেনা বেগমকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন তিনি। আশপাশের লোকজনের সহায়তায় আমেনা বেগমকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান তিনি।
আহত আক্তার হোসেন বলেন, তিনি একটি তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। গাজীপুর থেকে সায়েদাবাদ এসে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ লোকজন দৌড়াদৌড়ি শুরু করেন। অনেকে ভেবেছেন, হয়তো কোথাও মারামারি লেগেছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনিও দৌড় দেন। ওই সময় একটি বাস উল্টে তাঁর ওপর পড়লে তিনি আহত হন। আহত শারমিন আক্তার জানান, তিনি কুমিল্লা থেকে ঢাকার সায়েদাবাদে নামেন। পরে তিনি একটি রিকশায় ওঠেন। রেলক্রসিং অতিক্রম করার সময় বাসের নিচে চাপা পড়েন।
গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, আহত ব্যক্তিদের কয়েকজনকে জরুরি অস্ত্রোপচার কক্ষে নেওয়া হয়েছে। জরুরি বিভাগের বিছানায় আমেনা বেগম ব্যথায় ছটফট করছিলেন। তিনি চিৎকার করে বলে ওঠেন, ‘বাজান, আমার বাজান কই?’ অস্ত্রোপচার শেষে তাঁকে পর্যবেক্ষণ কক্ষে নেওয়া হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক এইচ এ নাজমুল হাকীম প্রথম আলোকে বলেন, আহত ব্যক্তিদের অধিকাংশের আঘাত গুরুতর।
হাসপাতালে মন্ত্রী ও মেয়র: রাতে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন পৃথকভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহত ব্যক্তিদের দেখতে যান। এ সময় তাঁরা চিকিৎসার খোঁজখবর নেন ও আহত ব্যক্তিদের সুষ্ঠু চিকিৎসা দেওয়ার পরামর্শ দেন।
মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ট্রেন-বাস সংঘর্ষের ঘটনায় চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী তিন কর্মদিবসে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
মেয়র এ ঘটনার জন্য রেলওয়ের গেটম্যানকে দায়ী করেন। তিনি প্রয়োজনে ওষুধপত্র দিয়ে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা-সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দেন।
No comments:
Post a Comment