সৃজনশীল প্রশ্ন
একটি তুলসী গাছের কাহিনী
নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
নদীভাঙন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ বাস্তুভিটা
হারিয়ে সর্বস্বান্ত ও আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে
তারা ছুটে আসে শহরে। দু-চারজনের বস্তিতে ঠাঁই মিললেও অধিকাংশই জীবনবঞ্চনার
শিকার হয়ে পথে-ঘাটে ও স্টেশনে-ফুটপাতে পড়ে থাকে। হরিদাস তাদেরই একজন।
হিন্দু বলে বস্তিতেও তার ঠাঁই মেলে না। অগত্যা সে লঞ্চঘাটের একটা নির্জন
স্থানে আশ্রয় পেয়ে যেন প্রাণ ফিরে পায়। একটা অচেনা কষ্টকে দীর্ঘশ্বাসে দূর
করতে চায় হরিদাস। কিন্তু তার চোখে কেবলই হারানো বাস্তুভিটার বেদনাময় চিত্র।
এরই মধ্যে হঠাৎ পুলিশের উচ্ছেদ অভিযানে হরিদাস আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে।
ক) কত দিনের মাথায় উদ্বাস্তু দল দখলকৃত বাড়িটি ছেড়ে দিয়েছিল?
অথবা, বাড়ি ছাড়ার মেয়াদ চব্বিশ ঘণ্টা থেকে বেড়ে কত দিন হয়েছিল?
খ) 'অন্যের অপমান দেখার নেশা বড় নেশা'_কথাটির প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যা দাও।
গ) নদীভাঙন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার মানুষগুলোর সঙ্গে 'একটি তুলসী
গাছের কাহিনী' গল্পের উদ্বাস্তু মানুষগুলোর কী সাদৃশ্য/বৈসাদৃশ্য রয়েছে?
ব্যাখ্যা করো।
ঘ) দেশ বিভাগের ফলে সৃষ্ট উদ্বাস্তু সমস্যা ও সাম্প্রদায়িকতা উদ্দীপকে
কিভাবে প্রতিফলিত/ প্রতিস্থাপিত হয়েছে? 'একটি তুলসী গাছের কাহিনী' গল্পের
সমাজবাস্তবতা আলোচনা প্রসঙ্গে বিশ্লেষণ করো।
উত্তর : ক. দশম দিনের মাথায় উদ্বাস্তু দল দখলকৃত বাড়িটি ছেড়ে দিয়েছিল।
অথবা, (উত্তর) : বাড়ি ছাড়ার মেয়াদ চব্বিশ ঘণ্টা থেকে সাত দিন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল।
খ) সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর 'একটি তুলসী গাছের কাহিনী' গল্পে দেশ বিভাগের
অব্যবহিত পরই ঢাকার একটি পরিত্যক্ত বাড়ি দখল করে কলকাতা থেকে আগত কয়েকজন
উদ্বাস্তু কর্মচারী।
কিন্তু ভাগ্য তাদের সুপ্রসন্ন নয়। উদ্বাস্তু দলটি বাড়ি দখল করার কয়দিনের
মাথায় পুলিশ এসে জানায়, সরকারের হুকুমে তাদের এ বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। এতে
বাড়ির নতুন বাসিন্দারা নানা রকম ওজর-আপত্তি তুলতে থাকে। এমতাবস্থায় আশপাশে
লোকজন জড়ো হয়। নিরাশ্রিত ভাগ্যাহত ওই উদ্বাস্তু দলটির তখনকার দুর্দশাপূর্ণ
পরিস্থিতিতে রাস্তায় কৌতূহলী জনতার ভিড় জমা প্রসঙ্গেই গল্পের লেখক আলোচ্য
উক্তিটি করেছেন। আমাদের সমাজের উৎসুক জনতার সাধারণ প্রবণতা হলো কারো কোনো
অপমানজনক পরিস্থিতিতে অতিমাত্রায় কৌতূহল প্রদর্শন। লেখক সাধারণ জনতার এই
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বোঝাতেই উক্তিটি করেছেন।
গ) সমাজসচেতন কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর 'একটি তুলসী গাছের কাহিনী' গল্পে
দেশ বিভাগের ফলে সৃষ্ট উদ্বাস্তু জীবনের সংকট চমৎকারভাবে অঙ্কিত হয়েছে।
দেশ বিভাগের ফলে ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের কারণে আপন নিবাস খুঁজে পেতে মানুষ
দেশত্যাগী হয়। আশ্রিত মানুষগুলো ঘরবাড়ি ছেড়ে অপর দেশে গিয়ে হয় অনাশ্রিত,
উদ্বাস্তু। তদ্রূপ উদ্দীপকের মানুষগুলোও নদীভাঙন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের
শিকার হয়ে বাস্তুভিটা হারিয়ে পরিণত হয় উদ্বাস্তুতে। এ যেন গল্পের উদ্বাস্তু
সংকটের আরেক প্রতিচিত্র।
গল্পে কলকাতা থেকে আগত মতিন, মোদাব্বের ও তার সঙ্গীরা ঢাকা শহরে এসে
আশ্রয়ের সন্ধানে উদয়াস্ত ঘোরাফেরা করতে থাকে। হঠাৎ একদিন তারা একটি নির্জন
তালাবদ্ধ পরিত্যক্ত বাড়ি পেয়ে ন্যায়-অন্যায়ের বোধ উপেক্ষা করে হৈ-হুল্লোড়
করে দখল করে নেয়। কলকাতার ঘিঞ্জি পরিবেশে জীবনযাপন আর উদ্বাস্তু জীবনের
অনিশ্চয়তা কাটিয়ে তারা ভাবতে থাকে, দখলকৃত বাড়িটি তাদের জন্য এক পরম
নির্ভরতার আশ্রয়। উদ্বাস্তু জীবনের উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা থেকে তারা যেন হাঁফ
ছেড়ে বাঁচে। ভিন্ন প্রেক্ষাপটে হলেও উদ্দীপকের মানুষগুলোও বাস্তুভিটা
হারিয়ে আশ্রয়হীন হয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে শহরে ছুটে আসে। নিঃস্ব হরিদাস
তাদেরই একজন। একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে শহরে এসে বস্তিতেও তার ঠাঁই
মেলে না। অগত্যা সে লঞ্চঘাটে আশ্রয় নেয়। কিন্তু সে আশ্রয়ও বেশি দিন স্থায়ী
হয় না। গল্পের উদ্বাস্তু মানুষগুলোর মতোই পুলিশের উচ্ছেদ অভিযানে আবার
আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। দেশ বিভাগের কারণেই হোক আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলেই হোক
তারা সবাই উদ্বাস্তু জীবনের গভীর সংকটে নিমজ্জিত। তারা বাস্তুভিটা হারিয়ে
আশ্রয়হীন উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। এদিক থেকে নদীভাঙন ও প্রাকৃতিক
দুর্যোগের শিকার মানুষগুলোর সঙ্গে 'একটি তুলসী গাছের কাহিনী' গল্পের
উদ্বাস্তু মানুষগুলোর সাদৃশ্য রয়েছে। বাস্তুহারা, সর্বহারা, অনাশ্রিত
জীবনের এমন মানবিক বাস্তবতাই জীবনসন্ধানী লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর 'একটি
তুলসী গাছের কাহিনী' গল্পে চিত্রিত হয়েছে।
ঘ) কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর 'একটি তুলসী গাছের কাহিনী' গল্পে দেশ
বিভাগের ফলে উদ্বাস্তু মানুষের দুঃখ-জর্জরিত অনিশ্চিত জীবনের কথা নিখুঁত
বর্ণনায় উপস্থাপন করেছেন।
উদ্দীপকে নদীভাঙন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে মানুষের জীবনের যে
দুর্ভোগপূর্ণ জীবনচিত্র ফুটে উঠেছে তা যেন গল্পের উদ্বাস্তু সংকটের আরেক
প্রতিচিত্র। গল্পের উদ্বাস্তু মানুষগুলোর মানবেতর জীবনযাপনের সঙ্গে
উদ্দীপকের উদ্বাস্তু মানুষগুলোর জীবনবঞ্চনার কোনো পার্থক্য নেই। উভয়
ক্ষেত্রেই সংকটময় উদ্বাস্তু জীবনের এক করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে।
লেখক তাঁর গল্পে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ায় সৃষ্ট
সামাজিক সমস্যার সামগ্রিক চিত্রটি তুলে ধরেছেন। দেশ ভাগের পেছনে সক্রিয় ছিল
জটিল রাজনীতি। এতে সৃষ্ট উদ্বাস্তু সমস্যাটিই প্রধানরূপে প্রতীয়মান হয়;
কিন্তু এর পেছনে সাম্প্রদায়িক সংকট প্রকটরূপে বিদ্যমান ছিল। সাম্প্রদায়িক
দাঙ্গা, অনেক মানুষের স্বদেশভূমি ত্যাগ, উদ্বাস্তুদের আগমনে সমাজজীবন
ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিল। পূর্ব বাংলা থেকে হিন্দুরা চলে যায় পশ্চিম বাংলায়।
পশ্চিম বাংলা থেকে মুসলমানরা চলে আসে পূর্ব বাংলায়। দেশত্যাগী হয়ে
হিন্দু-মুসলমান উভয়েই হারায় বাস্তুভিটা। ফলে তাদের জীবনে নেমে আসে চরম
দুর্দশা। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে মাথা গোঁজার একটু নিরাপদ আশ্রয়ের
প্রত্যাশায় এসব মানুষের মধ্যে দেখা যায় নৈতিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়।
সামাজিক অস্থিরতার ডামাডোলে জবরদখল, লুটতরাজ স্বাভাবিক মনে হয়। অবৈধ দখলের
মাধ্যমে কেউ কেউ আশ্রয় জোটাতে পারলেও জীবনের নিরাপত্তা, সংশয়ের মধ্যেই থেকে
যায়।
ভিন্ন প্রেক্ষাপটে হলেও উদ্দীপকে আমরা অনুরূপ চিত্রই প্রতিফলিত হতে দেখি।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার মানুষগুলোও বসতবাড়ি হারিয়ে সর্বস্বান্ত ও
আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে তারা ছুটে আসে শহরে।
ভাগ্যগুণে গল্পের উদ্বাস্তু মানুষগুলোর মতো পরিত্যক্ত বাড়ি পাওয়ার মতোই
নদীভাঙা মানুষগুলোর দু-চারজনের ঠাঁই মেলে বস্তিতে। গল্পের উদ্বাস্তুদের মতো
অনেককেই জীবন বঞ্চনার শিকার হয়ে পথেঘাটে, স্টেশনে-ফুটপাতে পড়ে থাকতে দেখা
যায়। হরিদাস তাদেরই একজন। গল্পে কলকাতা থেকে আগত মতিন, মোদাব্বেরসহ তাদের
সঙ্গীরা ঢাকার একটি পরিত্যক্ত বাড়ি দখল করে নিলেও উদ্দীপকের হরিদাসের কপালে
বস্তিও জোটে না। 'হিন্দুয়ানির চিহ্ন' তুলসী গাছটি শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেলেও
হিন্দু বলে হরিদাসের বস্তিতেও ঠাঁই মেলে না। পুলিশের উচ্ছেদ অভিযানে তার
জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। আর এই উদ্বাস্তু জীবনের দুর্ভোগ-দুর্দশার বেদনাময়
চিত্রটিই লেখক 'একটি তুলসী গাছের কাহিনী' গল্পে তুলে ধরেছেন।
শহিদুল ইসলাম
প্রভাষক
ন্যাশনাল আইডিয়াল কলেজ
খিলগাঁও, ঢাকা