Thursday, January 10, 2013

বেদখলে নগরীর সরকারি যাত্রী ছাউনি

মিরপুর বিআরটিসি বাস কাউন্টারের সামনে নাজিয়া সুলতানা তার বয়স্ক মাকে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ বাসের অপেক্ষায় ছিলেন। পাশে যাত্রী ছাউনি থাকলেও সেখানে মাকে বসানোর সুযোগ পান না নাজিয়া। ছাউনির অর্ধেকজুড়ে 'অলি জেনারেল স্টোর'। বাকি জায়গায় পত্রিকাসহ বিভিন্ন পণ্যের হকাররা নিজেদের পসরা সাজিয়ে বসেছে। ভোগান্তির কারণে অনেকটা বিরক্তি প্রকাশ করেই নাজিয়া বলেন, 'শহরে এখন শুধু নামেই যাত্রী ছাউনি আছে। কিন্তু এর অধিকাংশই ব্যবহার হচ্ছে ব্যবসায়িক কাজে।'
এ তো গেল মিরপুর এলাকার চিত্র। কিন্তু পথ চলতে গিয়ে গোটা রাজধানীতেই সরকারি অর্থায়নে নির্মিত যাত্রী ছাউনিগুলো আর সাধারণ যাত্রীদের কাজে আসছে না। এগুলো যে শুধু ব্যবসায়িক কাজেই ব্যবহার হচ্ছে, তা নয়, যাত্রীদের বদলে অনেক সময় পুলিশ সদস্যদেরও দল বেঁধে ছাউনিগুলোতে অলস সময় কাটাতে দেখা যায়। বিশেষ করে প্রেসক্লাব ও শাহবাগ এলাকায় এটি নিয়মিত ব্যাপার। অন্যদিকে বেসরকারি মোবাইল ফোন কোম্পানিসহ বিভিন্ন পণ্যের বিশাল বিলবোর্ডও এখন গিলে খাচ্ছে নগরীর যাত্রী ছাউনিগুলো। কিন্তু এদিকে যেন দৃষ্টি দেওয়ার কেউ নেই। ঢাকায় নির্মিত অধিকাংশ যাত্রী ছাউনিই বর্তমানে ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহার হচ্ছে। ফলে যাত্রী ছাউনিতে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রী ও ক্লান্ত পথচারীরা এখন আর এগুলো ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছেন না। যাত্রী ছাউনিগুলোতে মূলত মোবাইল ফোন রিচার্জ, জেনারেল স্টোর, ওষুধের দোকান, ফাস্টফুডের দোকানসহ বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে প্রথমে বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো যাত্রী ছাউনিগুলো লিজ নেন। পরবর্তীতে এ প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে চুক্তি অনুযায়ী বিভিন্ন এলাকার মাঝারি শ্রেণীর ব্যবসায়ীরা মাসিক ভাড়ার ভিত্তিতে যাত্রী ছাউনিগুলো খুচরা দোকানদারদের ভাড়া দেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯৮৫-৮৬ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) নগরীতে প্রায় দেড়শ' যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করে। সে সময় চুক্তির মাধ্যমে ডিসিসির সম্পত্তি বিভাগ থেকে যাত্রী ছাউনির একটি অংশে সংবাদপত্রের দোকান তৈরি করা যাবে এমন ব্যবস্থা রাখা হয়। এ চুক্তির মেয়াদ ২০১৩-১৪ সালে শেষ হওয়ার কথা।
কিন্তু শুধু সংবাদপত্রের দোকান তৈরির কথা থাকলেও পরে অবৈধভাবে যাত্রী ছাউনিগুলোর বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হতে থাকে। ডিসিসি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা যাত্রী ছাউনি থেকে কয়েকবার অবৈধ স্থাপনাগুলো সরিয়ে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা আদালতের ইনজেকশন নিয়ে ডিসিসিকে তাদের অবৈধ স্থাপনা ভেঙে ফেলা থেকে বিরত রাখেন। ডিসিসি জানায়, বর্তমানে নগরীতে ডিসিসির মাত্র ২৫ থেকে ৩০টির মতো যাত্রী ছাউনি অবশিষ্ট আছে। এ ব্যাপারে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপক ক্যাপ্টেন বিপন কুমার সাহা বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে বলেন, 'অসাধু ব্যবসায়ীরা কোর্ট থেকে স্টে অর্ডার নিয়ে যাত্রী ছাউনিতে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করছেন। আমরা চাই যাত্রীদের সুবিধার্থে দেশের বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো যাত্রী ছাউনি নির্মাণে এগিয়ে আসবে। এতে ছাউনিগুলোতে অন্যরা দোকান তৈরির সুযোগ পাবেন না এবং যাত্রীরাও আর ভোগান্তির শিকার হবেন না।
সম্প্রতি মিরপুর ১১ থেকে ১০ নম্বর পর্যন্ত তিনটি যাত্রী ছাউনি ঘুরে দেখা যায়, এগুলোর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জায়গায় গড়ে উঠেছে খাবার ও ওষুধের দোকান। ১০ নম্বর এলাকার সিটি করপোরেশন কার্যালয়ের সামনেই যাত্রী ছাউনিতে গড়ে উঠেছে 'অলি' নামক জেনারেল স্টোর। এ ছাউনির সামনে অবস্থিত বিআরটিসি কাউন্টারে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের যাত্রী ছাউনির পর্যাপ্ত জায়গার অভাবে প্রধান সড়কেই ঝুঁকি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এ ব্যাপারে দোকানের মালিক মুন্না জনান, বছরখানেক আগে 'নেপচুন' নামক একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এ যাত্রী ছাউনিতে দোকান নির্মাণের জন্য জমা বাবদ ৫০ হাজার টাকা জমা দেন। মাসে তাকে ভাড়া দিতে হয় আরও ৪ হাজার টাকা। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক যাত্রী বলেন, 'যাত্রী ছাউনির অবৈধ স্থাপনার কারণে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে সাধারণ যাত্রীদের বাসের অপেক্ষায় দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তবে বেশি কষ্ট হয় নারী, শিশু ও বয়স্কদের। দোকানের মালিক মুন্না বলেন, 'লোকসমাগম বেশি হওয়ায় ২০১২ এর বিশ্বকাপের পর এ জায়গাটিতে দোকান দিয়েছি। ব্যবসা ভালো হচ্ছে।' একই দিন সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, নগরীর ধানমন্ডি সিটি কলেজের সামনের যাত্রী ছাউনিটিতে অবৈধভাবে জেনারেল স্টোর, মোবাইল ফোন রিচার্জের দোকান ও ফটোকপির দোকান গড়ে উঠেছে। এতে গণপরিবহনের জন্য অপেক্ষমাণ শিক্ষার্থীসহ সাধারণ যাত্রীদের ছাউনির ব্যবহারের বদলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
এ ছাড়া কলেজ গেটের সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ও আসাদগেটে 'আড়ং'-এর উল্টোদিকের যাত্রী ছাউনিগুলোতে ওষুধ ও খাবারের দোকান তৈরি করা হয়েছে। ঢাকার পুরনো ও অপরিষ্কার যাত্রী ছাউনিগুলোর ভগ্নদশাই বলে দেয়, বহু আগে নির্মাণের কারণে এর বেশির ভাগই এখন ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া নোংরা পরিবেশের কারণে অব্যবহৃত থাকায় অনেক ছাউনিতে মাদকাসক্ত ও ভবঘুরে মানুষ থাকতে শুরু করেছেন। 


No comments: