রাজধানীর কদমতলী থানার হাবিবনগরে রাত নামতেই তরুণ ও বয়োজ্যেষ্ঠরা দল বেঁধে বেরিয়ে পড়েন পাহারা দিতে। সবার হাতে লাঠি ও টর্চ, মুখে বাঁশি। দুটি দলে ভাগ হয়ে তাঁরা প্রায় দুই কিলোমিটার রাস্তার এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত টহল দেন। কয়েকজন দাঁড়িয়ে থাকেন গলিমুখে। সন্দেহজনক কাউকে আসতে দেখলেই সংকেত দেওয়া হয়।
গত সোম ও মঙ্গলবার এলাকা ঘুরে দেখা গেছে এই চিত্র। জানা গেছে, কেবল হাবিবনগর নয়, ঢাকার দক্ষিণে মহাসড়কসংলগ্ন কদমতলী ও ডেমরা থানাধীন ডগাইর, মুসলিমনগর, পারডগাইর, কোনাপাড়া, রায়েরবাগ, মেডিকেল রোড, বাদশা মিয়া রোড, মুজাহিদনগর, মেরাজনগর, কদমতলী, মোহাম্মদবাগসহ ডিএনডি বাঁধের ভেতরের সবগুলো মহল্লাতেই এই চিত্র।
ডাকাতদের হাত থেকে বাঁচতেই এত আয়োজন। এসব এলাকায় ডাকাতির ঘটনা ঘটছে অহরহ। আর ডাকাত দলের উপদ্রব থেকে বাঁচতেই পুলিশের ওপর ভরসা না রেখে রাতভর এভাবেই পাহারা বসিয়েছে এলাকার মানুষ।
হাবিবনগর সমাজকল্যাণ সংঘের সভাপতি মনিরুল ইসলাম মানিক বললেন, ‘আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। শিশুদের জিম্মি করে, মারধর করে ডাকাতি হচ্ছে। ছেলেমেয়ের সামনে বৃদ্ধ বাবা-মাকে মারা হচ্ছে। এদের অত্যাচারের কারণেই সবাই কঠোর হয়েছেন।’ গত শুক্রবার রাতে এই হাবিবনগরেই ডাকাত সন্দেহে পাঁচজনকে পিটিয়ে মারা হয়।
কয়েকটি ঘটনা: ব্যবসায়ী জুয়েল মিয়ার সাড়ে তিন বছরের মেয়ে তাসমিয়া অন্তরা ভয়ে-আতঙ্কে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কুঁকড়ে থাকে সব সময়। গত মাসে ডাকাত হানা দিয়েছিল এই বাড়িতে। কলাপসিবল গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে তারা তাসমিয়াকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে। একপর্যায়ে শিশুটির হাঁটুর ওপর ছোরার উল্টোপিঠ দিয়ে সজোরে আঘাত করে তারা। এর ১০ দিন আগে বাড়ির নিচতলা থেকে জুয়েলের ছোট ভাই সোহেলের মোটরসাইল চুরি হয়ে যায়।
এর এক সপ্তাহ আগে একসঙ্গে তিন বাড়িতে ডাকাতি হয়। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মাসুদ খানের ৭০ বছরের বৃদ্ধ বাবা আফজাল খানকে নির্মমভাবে মারধর করে ডাকাতেরা। আফজাল খান এখনো সোজা হয়ে হাঁটতে পারেন না।
মাসুদ খানের স্ত্রী আমেনা বিনতে আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাত ১২টা-সাড়ে ১২টার দিকে শাবল দিয়ে দরজা ভাঙতে থাকে ডাকাতেরা। টের পেয়ে চিৎকার শুরু করি। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে পড়ে ডাকাতেরা। ঘরে ঢুকেই বাবাকে দেখতে পেয়ে তাঁর পিঠে শাবল দিয়ে আঘাত করে। শোবার ঘরে ঢুকে একজন আমার চুলের মুঠি আর গলায় দা ধরে বলে, একটা শব্দও করবি না। ভারী জিনিসপত্র (গহনা) কোথায় রাখছিস। এসব বলতে বলতে তারা নিজেরাই আলমারি খুলে ফেলে। আমার কান থেকে দুল টেনে খুলে নেয়।’
হাজীর বিল (ক্যানাল পাড়) এলাকার বাসিন্দা মোশাররফের বাসায় এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুবার হানা দেয় ডাকাতেরা। গত আগস্ট মাসের শুরুতে এক মঙ্গলবার হানা দিয়ে এলাকাবাসীর প্রতিরোধের মুখে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেলেও পরের মঙ্গলবার আবারও হানা দেয় ডাকাতেরা। প্রায় দেড় মাস হাসপাতালে থেকে এসে এলাকা ছেড়েছেন কাপড় ব্যবসায়ী মোশাররফ। নিজের বাড়ি ভাড়া দিয়ে অন্য জায়গায় বাসা ভাড়া নিয়েছেন তিনি।
আতঙ্ক আরও বেড়েছে: এলাকাবাসী বলেছে, পাঁচ ডাকাত মারার পর হাবিবনগর এলাকার আতঙ্ক আরও বেড়েছে। শুক্রবার ভোরে ধরা পড়া এক ডাকাতের মুঠোফোনে কল এলে স্থানীয় এক যুবক সেই ফোন ধরে। অপর প্রান্ত থেকে হুমকি দেওয়া হয়, ‘ভালোয় ভালোয় ছাড়বি, নইলে তোদের এলাকার অবস্থা আরও কাহিল করে দেব।’ এর পর থেকে আতঙ্ক আরও বেড়েছে। অনেক ভাড়াটে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। সব রকম নাগরিক সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এখানে বাড়িভাড়া এখন খুবই কম। তিন কক্ষের টাইলস করা বাড়ির ভাড়া সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা। তবু ভাড়াটে পাওয়া যায় না।
কঠোর নিয়মে পাহারা: এলাকার স্থানীয় যুবক লিটন, মানিকসহ অন্যরা জানান, আগে থেকেই এলাকায় পাহারা দেওয়া হতো। কিন্তু শিশু আর বৃদ্ধদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় সবাই বসে পাহারা জোরালো করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর সাত দিনের মাথায়ই মারা পড়ল পাঁচ ডাকাত।
এলাকার স্থানীয় সামাজিক সংগঠনগুলো এ বিষয়ে কড়া নিয়ম চালু করেছে। এলাকাভেদে প্রতি সপ্তাহে বা ১৫ দিনে একবার প্রতি বাড়ি থেকে একজন করে লোককে পাহারায় অংশ নিতে হবে।
হাবিবনগর খানকা রোড পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি দেলোয়ার হোসেন শিকদার জানান, এলাকায় প্রতি রাতে প্রায় ৩০ জন পাহারা দেন। বয়োজ্যেষ্ঠ ও যুবকদের দুটি দল খানকা রোড এলাকা পাহারা দেয়। এখানে প্রায় ১২০টি বাড়ি রয়েছে। প্রতি বাড়ি থেকে অন্তত একজনকে সপ্তাহে এক রাত পাহারা দিতে হয় এবং প্রতিটি বাড়ির বাইরে বাতি জ্বালানোর নিয়ম করা হয়েছে। তবে ২০ বছরের নিচে কাউকে পাহারায় নেওয়া হয় না। আর চাকরিজীবীরা পাহারা দেন বৃহস্পতি অথবা শুক্রবার রাতে।
উল্লেখ্য, গত ৪ সেপ্টেম্বর ডেমরার ডগাইরে ডাকাতদের হামলায় একজন নিরাপত্তারক্ষী নিহত হন এবং আহত হন আরও ছয়জন।
অপর্যাপ্ত পুলিশি তৎপরতা: ‘পুলিশ ডাকাইত পাহারা দিব কী, ডাকাইতে পুলিশরে চউক্ষে চউক্ষে রাহে।’ এভাবেই পুলিশ-ডাকাতের সমীকরণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন হাবিবনগর এলাকার বাসিন্দারা।
কদমতলী থানা সূত্র জানায়, থানায় গাড়ি রয়েছে মাত্র একটি। সেই গাড়ি ব্যবহার করছেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। প্রয়োজনে সেই গাড়ি দিয়েই কাজ চালানো হচ্ছে।
পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার গাজী মোজাম্মেল হক জানান, এলাকার মানুষ এখন বুঝতে পারছে যে পুলিশের জনবল পর্যাপ্ত নয়। এ কারণে তারা মাঠে নেমেছে, দল বেঁধে মহল্লা পাহারা দিচ্ছে। পুলিশও বিষয়টিকে উৎসাহিত করছে।
কদমতলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী আইয়ুবুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, থানায় এখন ৫৫ জন কনস্টেবল ও ৪০ জন কর্মকর্তা (এসআই ও এএসআই) রয়েছেন। কয়েকটি গাড়ি রিকুইজিশন করে কাজ চালানো হচ্ছে। গত এক মাসে তিনটি ডাকাতি মামলা হয়েছে বলে তিনি জানান।
No comments:
Post a Comment