পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে মাত্র ৬২ কিলোমিটার উত্তরের আবোত্তাবাদ। রবিবার। স্থানীয় সময় রাত ১০টা ৩০ মিনিট। নিশ্চিত খবরের ভিত্তিতে আফগানিস্তান থেকে সামরিক হেলিকপ্টারে উড়ে এলেন মার্কিন মেরিন বাহিনীর চৌকস একদল কমান্ডো। লক্ষ্য 'যুক্তরাষ্ট্রের এক নম্বর শত্রু' আল-কায়েদার শীর্ষ নেতা ওসামা বিন লাদেন। মুহূর্তেই সুরক্ষিত একটি ভবনের চারপাশে অবস্থান নেন তারা। এ ভবনেই পলাতক জীবন যাপন করছেন আল-কায়েদার শীর্ষ নেতা ওসামা বিন লাদেন। ততক্ষণে বিষয়টি টের পেয়ে গেছেন বিন লাদেনের অনুগত যোদ্ধারা। কিন্তু হলে কী হবে, শেষরক্ষা হয়নি। ৪০ মিনিটের ওই রুদ্ধশ্বাস অভিযানে আপ্রাণ চেষ্টা করেও বিন লাদেনকে বাঁচাতে পারেননি তারা। মার্কিন এ অভিযানে লাদেন ছাড়াও নিহত হয়েছেন তার এক ছেলেসহ তিনজন। ওয়াশিংটন বিন লাদেনের নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, লাদেনকে হত্যার মাধ্যমে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে যুক্তরাষ্ট্র বড় বিজয় অর্জন করল। বেশ কয়েক বছর ধরেই এমন খবর বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল যে আল-কায়েদা শীর্ষ নেতা বিন লাদেন পাকিস্তানের দূরবর্তী উপজাতি-অধ্যুষিত এলাকায় লুকিয়ে আছেন। আবার কখনো এমনও খবর বেরিয়েছে, আল-কায়েদার শীর্ষ এই নেতা লুকিয়ে আছেন আফগানিস্তানেরই কোনো সীমান্ত এলাকায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে সে স্থানে পাওয়া গেল, যেখান থেকে পকিস্তানের রাজধানী খুব বেশি দূরে নয়। শুধু তা-ই নয়, যে ভবনে অভিযান চালানো হয়েছে, সেটি পাকিস্তানের অন্যতম একটি সেনানিবাসের অত্যন্ত নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় আবৃত এলাকায় অবস্থিত।
আবোত্তাবাদ এলাকায় প্রায় নয় হাজার বর্গফুট জমির ওপর তিনতলা ভবন। চারদিক ১৪ ফুট উঁচু দেয়ালে ঘেরা। দেয়ালের ওপর কাঁটাতারের বেড়া। ইন্টারনেট বা টেলিফোন সংযোগ নেই। ওই ভবনে স্ত্রী-পরিজনসহ অবস্থান করছিলেন মার্কিন মোস্ট ওয়ান্টেড ওসামা বিন লাদেন। হঠাৎই এমন খবর চলে আসে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। এমন খবরের ভিত্তিতে অভিযানের জন্য দ্রুত প্রস্তুত হয় আফগানিস্তানে থাকা মার্কিন বাহিনী। কিন্তু খবরটি আসলে কতটুকু নিশ্চিত সে বিষয়ে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিল তারা। কারণ এর আগেও বহুবার এ ধরনের খবরের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করেছে তারা। নিষ্ফল হয়েছে সেসব অভিযান। বিষয়টি তারা পরিষ্কার হয় পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর সহযোগিতায়। এরপর আর দেরি নয়। আফগানিস্তান থেকে উড়ে আসে বেশ কয়েকটি সামরিক হেলিকপ্টার। শুরু হয় রুদ্ধশ্বাস এক অভিযান। সঙ্গে ছিলেন আইএসআইয়ের কর্মকর্তারাও।
ভবনটির ওপর দিয়ে প্রথমে সামরিক হেলিকপ্টারগুলো বেশ কয়েকবার চক্কর দেয়। এর পরই সেগুলো নেমে আসে মাটিতে। অবস্থান নেয় ভবনের আশপাশে। হেলিকপ্টারগুলো থেকে বের হয়ে আসেন ১৫ থেকে ২০ জন মার্কিন সেনা। তারা ছিলেন বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিত। হেলিকপ্টার থেকে প্রথম তারা কথা বলেন আশপাশে বসবাসকারী কয়েকটি বাড়ির বাসিন্দাদের সঙ্গে। সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে তাদের লক্ষ্যবস্তু ওই ভবন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়। জবাবে তারা জানান, বাড়িটি ১৪-১৫ বছর আগে এক পশতুন নির্মাণ করেন। এখন এটি ভুতুড়ে বাড়ি বলেই তাদের কাছে পরিচিত। এখানে যারা বসবাস করেন, তারা খুব একটা বাইরে বের হন না। যা-ও দু-একজন বের হন, তারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেশেন না। জানাশোনার পর্ব শেষে মার্কিন সেনারা আশপাশের বাসিন্দাদের দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরের ভেতর অবস্থান করার অনুরোধ জানান। এ সময় বন্ধ করে দেওয়া হয় ওই এলাকার বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। অন্ধকারে ডুবে যায় পুরো এলাকা। শুরু হয় মূল অভিযান।
যে বাড়িতে বিন লাদেন অবস্থান করছিলেন, এতে প্রবেশের ফটক ছিল দুটি। চারদিক থেকে ভবনটি ঘেরাও করে ফেলা হয়। অবস্থান নেওয়া হয় দুই ফটকে, যাতে কোনোভাবেই পালিয়ে যেতে না পারেন আল-কায়েদা নেতা। শুরু হয় প্রচণ্ড গোলাগুলি। প্রতিরোধে সর্বাত্মক চেষ্টা চালান ভবনে অবস্থান করা তার অনুগতরা। কিন্তু প্রশিক্ষিত আর অস্ত্রসজ্জিত মার্কিন বাহিনীর সামনে বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেননি তারা। সর্বশেষ চেষ্টা নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে নেতাকে বাঁচিয়ে রাখা। সে ভাবনা থেকেই, মার্কিন সেনারা যখন খুব কাছাকাছি, লড়াই করার রসদ যখন ফুরিয়ে গেছে, ঠিক তখন, বিন লাদেনকে মাঝখানে রেখে চারদিকে মানব-বর্ম রচনা করেন অনুগতরা। মানব-বর্মে অংশ নেন একজন নারীও। মার্কিন সেনারা গুলি ছুড়তে থাকে মানব-বর্ম লক্ষ্য করে। ঝাঁজরা হয়ে যায় মানব-বর্ম। লুটিয়ে পড়তে থাকেন অংশ নেওয়া ব্যক্তিরা একে একে। নিহত হন বিন লাদেনের এক ছেলে, একান্ত অনুগত ও সবচেয়ে বিশ্বস্ত এক বার্তাবাহক। নিহত হন মানব-বর্মে অংশ নেওয়া ওই নারীও। তবে তিনি বিন লাদেনের চতুর্থ স্ত্রী কি না, এ নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
রুদ্ধশ্বাস মার্কিন এ অভিযানের শেষ সময়টা পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন বিন লাদেন। ওই সময় তাকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়। কিন্তু নিজ সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন আল-কায়েদা নেতা। জানিয়ে দেন, 'ইসলামের শত্রু' যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ নয়। বীর কখনো আত্মসমর্পণ করে না। মৃত্যু হলে হোক। এর পরই অত্যাধুনিক অস্ত্র তাক করে বেশ কয়েকটি গুলি করা হয় বিন লাদেনের মাথায়। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন 'যুক্তরাষ্ট্রের এক নম্বর শত্রু'। শেষ হয় বিন লাদেন উপাখ্যানের।
লাদেনের নিহত হওয়ার পর বিষয়টি হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়। নিহত ব্যক্তি বিন লাদেন কি না, এ জন্য করা হয় ডিএনএ পরীক্ষা।
এদিকে মার্কিন অভিযানে বিন লাদেন নিহত হয়েছেন বলে যে দাবি করেছে ওয়াশিংটন, এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি আল-কায়েদা। তাদের পক্ষ থেকে বিষয়টি স্বীকারও করা হয়নি। তবে লাদেনকে হত্যার পর তার অনুগতরা যে কোনো ধরনের ক্ষতি করতে পারে আশঙ্কায় মার্কিন নাগরিকদের চলাফেরার ওপর সতর্কতা জারি করেছে ওয়াশিংটন। সূত্র : রয়টার্স, বিবিসি ও দ্য গার্ডিয়ান।