Thursday, May 9, 2013

কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ

জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অপহরণ, নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণসহ একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে দুটি অভিযোগে তাঁকে সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। অন্য দুটি অভিযোগে যাবজ্জীবন ও আরেকটি অভিযোগে ১০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও মো. শাহিনুর ইসলাম সমন্বয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ রায় ঘোষণা করেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার এটি চতুর্থ রায়।
কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে থাকা সাতটি অভিযোগের মধ্যে ১, ২, ৩, ৪ ও ৭ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। ৫ ও ৬ নম্বর অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে পারেনি বলে জানান ট্রাইব্যুনাল-২। এ দুটি অভিযোগ থেকে তাঁকে খালাস দেওয়া হয়।

রায় পড়া শুরু

কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আজ বেলা ১১টা ২২ মিনিটে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এর সদস্য বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম রায় পড়া শুরু করেন। বেলা দুইটার দিকে ট্রাইব্যুনাল দণ্ড ঘোষণা করেন।
এর আগে বেলা ১১টা ১০ মিনিটে এজলাসে আসেন বিচারপতিরা। ১১টা ৫ মিনিটে ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় কামারুজ্জামানকে তোলা হয়।
এরপর ১১টা ১৮ মিনিটে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান সূচনা বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, আজকের এ রায়টি ২১৫ পৃষ্ঠার। এতে ৬৫১টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। এ রায়ের ৬২ পৃষ্ঠার সারাংশ পড়া হবে। ৬২ পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্ত এ রায়ের প্রথম অংশ পড়েন বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম। দ্বিতীয় অংশটি পড়েন বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া। রায়ের তৃতীয় অংশটি পড়েন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
সূচনা বক্তব্যে ওবায়দুল হাসান ট্রাইব্যুনাল-২-এর সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান এ টি এম ফজলে কবীরকে ধন্যবাদ জানান। একই সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের ধন্যবাদ জানান তিনি।

ট্রাইব্যুনালে কামারুজ্জামান

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আজ সকাল সাড়ে নয়টার দিকে কামারুজ্জামানকে শিশু একাডেমীসংলগ্ন ফটক দিয়ে ট্রাইব্যুনালে নেওয়া হয়। এরপর ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় তোলার আগ পর্যন্ত তাঁকে হাজতখানায় রাখা হয়।
রায় ঘোষণা উপলক্ষে কামারুজ্জামানকে কাশিমপুর কারাগার থেকে গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসা হয়।

ফিরে দেখা

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে করা মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই বছরের ২ অক্টোবর তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল-১-এ তাঁর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। ২০১২ সালের ১৬ এপ্রিল মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-২-এ স্থানান্তর করা হয়।
ট্রাইব্যুনাল-২ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ২০১২ সালের ৪ জুন মানবতাবিরোধী অপরাধের সাতটি অভিযোগ গঠন করেন। ২ জুলাই এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য নেওয়া শুরু হয়। তদন্ত কর্মকর্তাসহ রাষ্ট্রপক্ষের ১৮ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন এবং আসামিপক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন পাঁচজন। উভয় পক্ষের সাক্ষ্য নেওয়া শেষে চলতি বছরের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয় এবং শেষ হয় ৩১ মার্চ। আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন ২ এপ্রিল শুরু হয়ে ১৫ এপ্রিল শেষ হয়। যুক্তি উপস্থাপন শেষে ১৬ এপ্রিল মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষাধীন রাখেন ট্রাইব্যুনাল।

সাত অভিযোগ

কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ হলো, একাত্তরের ২৯ জুন তাঁর নেতৃত্বে আলবদররা শেরপুরের ঝিনাইগাতী থানার রামনগর গ্রামের বদিউজ্জামানকে অপহরণ ও নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা করে।
দ্বিতীয় অভিযোগ অনুযায়ী, কামারুজ্জামান ও তাঁর সহযোগীরা শেরপুর কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল হান্নানকে প্রায় নগ্ন করে শহরের রাস্তায় হাঁটাতে হাঁটাতে চাবুকপেটা করেন।
তৃতীয় অভিযোগ, ২৫ জুলাই কামারুজ্জামানের পরামর্শে পরিকল্পিতভাবে আলবদর ও রাজাকার বাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে শেরপুরের নালিতাবাড়ীর সোহাগপুর গ্রামে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালায় ও নারীদের ধর্ষণ করে।
চতুর্থ অভিযোগ, কামারুজ্জামানের নির্দেশে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা গুলি করে শেরপুরের গোলাম মোস্তফাকে হত্যা ও আবুল কাসেমকে আহত করে।
পঞ্চম অভিযোগ অনুসারে, মুক্তিযুদ্ধকালে কামারুজ্জামান ও সহযোগীরা শেরপুরের লিয়াকত আলী ও মুজিবুর রহমান পানুকে অপহরণ ও নির্যাতন করে।
ষষ্ঠ অভিযোগ, একাত্তরের নভেম্বরে কামারুজ্জামানের নির্দেশে আলবদররা টুনু ও জাহাঙ্গীরকে আটকের পর নির্যাতন করে। টুনুকে হত্যা করা হয়।
সপ্তম অভিযোগে বলা হয়েছে, কামারুজ্জামান ও আলবদরের সদস্যরা ছয়জনকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।

রায় ঘিরে ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা

এ রায়কে কেন্দ্র করে ট্রাইব্যুনাল এলাকায় নিরাপত্তাবেষ্টনী গড়ে তোলা হয়েছে। ওই এলাকায় পুলিশ, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এ ছাড়া নিরাপত্তার অংশ হিসেবে প্রেসক্লাবসংলগ্ন কদম ফোয়ারা সড়ক, শিক্ষা ভবনসংলগ্ন সড়ক, দোয়েল চত্বরসংলগ্ন সড়ক ব্যারিকেড দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। ফলে ওই সব সড়ক দিয়ে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। তবে পথচারীরা চলাচল করতে পারছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কাউকে সন্দেহ হলে তাঁর পরিচয়পত্র দেখছেন।
নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে পুলিশের রমনা অঞ্চলের অতিরিক্ত কমিশনার এস এম শিবলী নোমান জানান, এর আগে তিনটি রায় হয়েছে। রায়ের পরবর্তী পরিস্থিতি মাথায় রেখে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
আদালত চত্বরের প্রতিটি পয়েন্টে নেওয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা। ট্রাইব্যুনালের প্রবেশমুখে গণমাধ্যমকর্মীদের সরব উপস্থিতি লক্ষণীয়।

আগের তিন রায়

চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার প্রথম রায়ে ট্রাইব্যুনাল-২ জামায়াতের সাবেক সদস্য (রুকন) পলাতক আবুল কালাম আযাদকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। একই ট্রাইব্যুনাল ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন। ২৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল-১ সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। কাদের মোল্লা ও সাঈদীর দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে করা আপিল বিচারাধীন রয়েছে আপিল বিভাগে। ট্রাইব্যুনাল-১-এ অপেক্ষাধীন রয়েছে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মামলার রায়।

No comments: