Wednesday, September 1, 2010

অ্যানথ্রাক্স আতঙ্কে গরুর মাংস বিক্রি কমেছে

অ্যানথ্রাক্স আতঙ্কে গরুর মাংস খাওয়া ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিয়েছেন রাজধানীবাসী। রেস্তোরাঁগুলোতেও গরুর মাংসের চাহিদা কমে গেছে। অনেকে ভয়ে খাসির মাংস কেনাও ছেড়ে দিয়েছেন।
গরুর মাংসে বিপদের ভয়ে চাহিদা বেড়েছে মুরগির। চাপ বেড়েছে মাছের বাজারেও।
সিরাজগঞ্জ ও পাবনার সাতটি উপজেলায় গরুর মধ্যে অ্যানথ্রাক্স রোগ ছড়িয়ে পড়ে বেশ কয়েকটি পশু মারা গেছে। সেখানে শতাধিক লোক এ পর্যন্ত অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়েছে।
সরকারি কর্তৃপক্ষ পশুর চালান ঢাকায় ঢোকার আগে পরীক্ষা হচ্ছে, অ্যানথ্রাক্স ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা নেই ইত্যাদি আশ্বাসের কথা শোনাচ্ছে। কিন্তু এতে দৃশ্যত নাগরিকেরা ভরসা পাচ্ছেন না। আর জবাইয়ের আগে পশুর যথাযথ স্বাস্থ্য পরীক্ষার নিশ্চয়তা না থাকাও গরু-খাসির মাংস এড়িয়ে চলার বড় কারণ। গরু, ছাগল ও ভেড়া এসব চতুষ্পদ গবাদিপশুরই অ্যানথ্রাক্স বা তড়কা রোগটি হয়।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে ঘুরে দেখা গেছে, কসাইয়ের দোকানে সকালে ঝুলিয়ে রাখা গরুর রান বিকেল পর্যন্ত ঝুলছে। মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন দোকানি। বিষণ্নমুখে খিলগাঁও কাঁচাবাজারের মাংসবিক্রেতা সোলেমান মিয়া প্রথম আলোকে জানান, সাধারণত রোজার মাসে গরুর মাংস বিক্রি হয় সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন, অ্যানথ্রাক্সের ভয়ে ক্রেতা নেই। সোলেমান বলেন, ‘কিনবে কী? বাঁধা খদ্দেররাও এক মুহূর্তের জন্য দোকানে দাঁড়ায়ও না। পাছে রোগে ধরে!’
কারওয়ান বাজারের ‘চারুলতা’ রেস্তোরাঁয় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গরুর মাংসের ঝোল ও ভুনা তরকারিসহ প্রতিটি আইটেমের চাহিদা কমে গেছে। কেউ বিরিয়ানির সঙ্গে গরুর টিকিয়া খাচ্ছেন না।
পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, খাসির কাচ্চি, খাসির বিরিয়ানি ও মোরগপোলাওয়ের যথেষ্ট চাহিদা থাকলেও দুই সপ্তাহ ধরে কমে গেছে গরুর মাংসের তেহারি ও অন্যান্য খাবারের চাহিদা।
রোববার নিউমার্কেটের গরুর মাংসের দোকানে মাছি আর বিক্রেতা নিজে ছাড়া কোনো প্রাণী দেখা যায়নি। বিক্রেতা মোহসীন জানালেন, তাঁরা সাধারণত দিনে কম করেও ১৫টি গরু রাখতেন। এখন সারা দিনেও পুরো একটি গরু বিক্রি হচ্ছে না। মোহসীন বলেন, কোনো কোনো রেস্তোরাঁ কম করে হলেও দিনে ১০০ কেজি মাংস নিত। গত দুই সপ্তাহে তা ৪০ থেকে ৪৫ কেজিতে নেমে এসেছে।
ঠিক উল্টো চিত্র মুরগির বাজারে। মাংস ছাড়া যাদের চলে না তাদের ভিড় এখন সেখানেই। ব্রয়লারের দাম কেজিপ্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়েছে। খিলগাঁও বাজারে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজি ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা। এ ছাড়া গোড়ান কাঁচাবাজারে তা ১২০ থেকে ১২৫, নিউমার্কেট কাঁচাবাজারে ১৪০ থেকে ১৫০, কারওয়ান বাজারে ১২৫ থেকে ১৩৫ ও হাতিরপুল বাজারে ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা।
দেশি মুরগির দামও বেড়ে গেছে। মাঝারি আকারের একটি মুরগির (সর্বোচ্চ পৌনে এক কেজি) দাম সাড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। আর এক হালি বাচ্চা মুরগি বিক্রি হচ্ছে এক হাজার টাকায়! দামাদামি করার সুযোগও দিচ্ছেন না বিক্রেতারা।
হাতিরপুল বাজারের মুরগি বিক্রেতা আবদুল করিমের সহকারী খোকন (১২) জানায়, ‘আল্লায় আমাগো দিকে মুখ তুইলা তাকাইছে। হেইবার বার্ড ফ্লুর লাইগা বেচাবিক্রি বন্ধ হইছিল। সেমাই দিয়াই ঈদ সারছিলাম। এবার চাচায় বোনাস দিব কইছে। ’
নিউমার্কেটের মুরগি ব্যবসায়ী কাসেম আলী বলেন, ‘সাধারণত রমজানে কেনাবেচা তেমন হয় না। কিন্তু গত ১২-১৩ দিনে অসুখের ভয়ে সবাই মুরগি কিনছে। বেচাকেনাও যথেষ্ট ভালো।’ সব বাজারেই মুরগির দাম আরও বাড়বে বলে তাঁর ধারণা।
ক্রেতা মো. আরমান আলী সোমবার দুই হালি ব্রয়লার মুরগি কিনেছেন দেড় হাজার টাকায়। কেজিপ্রতি দাম পড়েছে ১৫০ টাকা। তিনি জানালেন, গত সপ্তাহেই মুরগি কিনেছেন কেজিপ্রতি ১২৫ টাকা করে। তার আগের সপ্তাহে কিনেছিলেন ১১৫ টাকায়।
কসাইখানায় চিকিৎসক নেই: সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, দিনে রাজধানীতে গড়ে ৭০০ গরু, ২৫০টি মহিষ ও চার-পাঁচ হাজার ছাগল-ভেড়া জবাই করা হয়। এর মধ্যে ডিসিসির আওতায় ঢাকার পাঁচ জায়গায় জবাই করা হয় প্রায় দেড় হাজার পশু। তবে এখন চিকিৎসক রয়েছেন শুধু দুটি স্থানে। অভিযোগ রয়েছে, কাগজ-কলমে সই থাকলেও ডিসিসির ওই পশু চিকিৎসকেরা প্রায়ই কসাইখানায় উপস্থিত থাকেন না। ফলে প্রায়শই কোনো রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই পশু জবাই করা হয়। আর যথাযথ পরীক্ষার ব্যবস্থাও নেই।
সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মো. নাসিরউদ্দিন প্রথম আলোকে জানালেন, সিটি করপোরেশনে মাত্র তিনজন চিকিৎসক ও ১০ জন পরিদর্শক রয়েছে। তিনি বলেন, ‘বাইরে থেকে দেখেই পশুটি জবাইয়ের উপযুক্ত কি না সে অনুমতি দেই আমরা। রোগ পরীক্ষার আধুনিক কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রয়োজনীয় জনবলেরও ঘাটতি রয়েছে। এ অবস্থায় রোগাক্রান্ত পশু সব সময় চিহ্নিত করা সম্ভবও হয় না।’
বিশেষজ্ঞদের কথা: অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত পশু জবাই বা এর মাংস রান্নার জন্য তৈরি করতে গেলেই যেহেতু আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে, সেহেতু এর মাংস খাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী রুহুল হক বলেন, আক্রান্ত পশু নিধন করে মাটির ছয় ফুট নিচে পুঁতে ফেলতে হবে। মন্ত্রী বলেন, সিরাজগঞ্জ ও পাবনার সাতটি উপজেলায় অ্যানথ্রাক্স রোগ দেখা দিলেও এটি বর্তমানে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। মানুষের মধ্যে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা নেই।
ঢাকার পথে তল্লাশি চৌকি: মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাস প্রথম আলোকে জানান, রাজধানীতে অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত পশুর চালান আসা ঠেকাতে নগরের প্রবেশপথগুলোতে তল্লাশি চৌকি বসানো হয়েছে। সেখানে স্বাস্থ্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে ঢাকায় প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছেন।
ডিসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মো. নাসিরউদ্দিন অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত পশু শনাক্তকরণে একটি কমন করিডরের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, রাজধানীতে ঢোকার মুখে একটা নির্দিষ্ট স্থানে সব পশু এনে জমা করতে পারলে সবচেয়ে ভালো। এতে করে বাছাই করে পশু রাজধানীতে ঢোকানো যেত।

No comments: